রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থের প্রথমেই লিখেছিলেন, ‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না, কিন্তু যে আঁকে সে ছবিই আঁকে।’ স্মৃতিকথা যে প্রামাণ্য কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়, স্মৃতিপটে এঁকে যাওয়া কিছু কিছু ছবি মাত্র, এ কথাটা বলে তিনি স্মৃতিকথার লেখককে সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন। আমার দিনলিপি লেখার অভ্যাস নেই। এখন বয়স হয়েছে অনেক। এমনিতেই সব কথা ভুলে যাই। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনাগুলোর সন-তারিখ, পাত্র-মিত্রও তেমন মনে করতে করতে পারি না। চলে যাওয়ার আগে মূল কথাটি যদি বলে যেতে পারি, তা হলেই যথেষ্ট হবে আশা করি। সহৃদয় পাঠক, আমার স্মৃতিচারণার এসব দুর্বলতা ক্ষমাসুন্দর চোখ দেখবেন।
উনিশ শ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় স্কুলের ক্লাস ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছি, সাতই মার্চের ‘বজ্রকণ্ঠ’ ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর মঞ্চের পাশেই ছিলাম, স্বাধীনতাসংগ্রামকালে শেষের চার মাস বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদে অজ্ঞাতবাস করেছি, কিন্তু সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধ করিনি, ছা-পোষা মধ্যবিত্ত জীবনের নানা সংশয় আর উদ্বেগের চাপে সীমান্ত পারেও যাওয়া হয়নি। তাই নবগঠিত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১২, ১৩ তারিখের দিকে যখন ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর অফিসের উপসচিব পদে কাজ করতে চাই কি না, তখন খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম। বললাম, ‘রফিক ভাই, আমি তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি। বঙ্গবন্ধুর অফিসে আমি কী করে কাজ করব?’ রফিকুল্লাহ বললেন, ‘সে আমি দেখব। তুমি কালই আমার অফিসে চলে এসো।’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ছবি: সংগৃহীত
পরদিন সচিবালয়ে রফিকুল্লাহ নবনিযুক্ত সব কর্মচারীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে ইশারা করে বললেন, ‘তুমি একটু বসো।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পূর্বপরিচয় ছিল না। প্রমাদ গুনলাম। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে পাইপ টানছেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোনো সময়ে ছাত্রলীগ করতে?
-জি না, স্যার।
ভেবে দেখলাম, তাঁর অফিসে আমি ছাড়া আর সবাই আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। আমি ছাত্র কেন, কোনো রাজনীতিই কখনো করিনি।
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আবার জিজ্ঞেস করলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়াতে কোথায় ছিলে?
-স্যার, আমি ইন্ডিয়াতে যাইনি। মুক্তিযুদ্ধও করিনি। তবে পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।
নিশ্চিত বুঝলাম, আমাকে অন্য কোনো অফিসে চলে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অফিসে আর থাকা হবে না ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল।
আবার কিছুক্ষণ বিরতির পর হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, শোনো, প্রধানমন্ত্রীর অফিস একটা আধা রাজনৈতিক কাজের জায়গা। এখানে সব সময়ই রাজনৈতিক লোকজন আসবে। তারা তোমাকে চিনবে না, নানা প্রশ্ন করে বিব্রত করবে। তখন তুমি বলো, তুমি ছাত্রলীগের সমর্থক আর মুক্তিযোদ্ধা ছিলে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাও তো বাংলাদেশের ভেতরেই ছিল। চাকরি ছেড়ে দেওয়াও এক ধরনের মুক্তিযুদ্ধ।
-এ রকম মিথ্যা কথা বললেই কি তারা বিশ্বাস করবে?
-তোমাকে বিশ্বাস করতে না পারলে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করবে। তখন আমি বলে দেব, তুমি আমাদেরই লোক!
আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তাঁকে সালাম করে, ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। একটা অসাধারণ মনের পরিচয় পেয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। কী ভেবে তিনি সেদিন সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন সরকারি কর্মচারীকে এমন আপন কর নিলেন, তার কোনো কারণ আজও আমি খুঁজে পাইনি। তবে এটুকু বুঝি ‘মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ’ এই কথার মূল্যবোধটি তিনি নিজের জীবনের বিনিময়েও পালন করে গেছেন।