বাদ্যযন্ত্র সঙ্গীতোপযোগী শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র। এগুলি কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতে ব্যবহূত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে খননকার্য ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে অতি উন্নতমানের এক সাঙ্গীতিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রেরও পরিচয় মেলে। সিন্ধুসভ্যতায় বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে দুন্দুভি, ভূমি-দুন্দুভি, বেণু, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
গঠন ও উপাদানগত দিক থেকে বাদ্যযন্ত্রসমূহ তত, শুষির, ঘন ও আনদ্ধ এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত। ততযন্ত্র তারসংযুক্ত, ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় যেগুলি সেগুলি শুষির, ধাতুনির্মিত যন্ত্র ঘন এবং চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্রের নাম আনদ্ধ। তত ও শুষিরযন্ত্র সঙ্গীত বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেও বাজানো যায়, আবার এককভাবেও বাজানো যায়। তাই এগুলির অপর নাম স্বয়ংসিদ্ধ যন্ত্র, যেমন সেতার, সরোদ প্রভৃতি। কিন্তু ঘন ও আনদ্ধ যন্ত্র কেবল গান বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেই বাজানো যায়; এগুলির একক কোনো প্রয়োগ নেই; গায়ক ও বাদকের তাল ও ছন্দ ঠিক রাখাই এগুলির কাজ। তাই এগুলির অপর নাম অনুগতসিদ্ধ, যেমন তানপুরা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি; কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। পন্ডিতদের ধারণা, ড্রামাদি আনদ্ধ বাদ্য সর্বাগ্রে আবিষ্কৃত হয়; পরে মানুষ তত জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আয়ত্ত করে। শুষির ও ঘন জাতীয় যন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে আরও পরে।
তত জাতীয় যন্ত্রগুলি দুপ্রকারের: অঙ্গুলিত্র মিজরাব, গুটি বা জওয়া দিয়ে বাজানো হয় এবং ধনুস্তত বা ধনুযন্ত্র ছড়ের সাহায্যে বাজানো হয়। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ততযন্ত্রই বেশি। এগুলির সৃষ্টির পেছনে ধনুকের অবদান রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ধনুকে সংযোজিত তার বা গুণ ছোট বা বড় হলে সুরের তারতম্য ঘটে। তাছাড়া তারে অধিক টান দিলে স্বর চড়ে, ঢিল দিলে নামে। স্বরের এই ওঠা-নামা থেকেই প্রথমত বেশ কয়েক প্রকার বাদ্যযন্ত্রের সৃষ্টি হয়।
অতীতে বঙ্গদেশে যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহূত হতো সেসবের অনেকগুলিই বর্তমানে বিলুপ্ত বা অব্যবহূত; আবার বর্তমানে অনেক নতুন যন্ত্রেরও আবির্ভাব ঘটেছে। অতীত ও বর্তমানের সেসব যন্ত্রকে সাধারণভাবে চারটি ভাগে ভাগ করা যায় লোক, উপজাতীয়, উচ্চাঙ্গ ও আধুনিক।
লোকবাদ্যযন্ত্র প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহূত হয়। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে ঢোল-কাঁসর-শঙ্খধ্বনি অত্যাবশ্যক। কোনো কোনো দেবতার মূর্তিকল্পনায়ও বাদ্যযন্ত্রের যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। শঙ্খধারী বিষ্ণু, ডমরুধারী শিব, মুরলীধারী কৃষ্ণ এবং বীণাধারিণী সরস্বতীর মূর্তি এভাবেই কল্পিত হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে সরস্বতী ‘বীণাপাণি’ এবং কৃষ্ণ ‘মুরলীধর’ নামে পরিচিত। মুসলমানদের বিবাহানুষ্ঠানে সানাই বাজানো হয়, আর হিন্দু বিয়েতে বাজানো হয় সানাই, শঙ্খ, ঢোল, কাঁসর ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, হিন্দুদের মধ্যে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি দিয়ে বধূবরণ ও নবজাতকের আবির্ভাব ঘোষণা করা হয়। এছাড়া শবযাত্রা, শোভাযাত্রা এবং যুদ্ধযাত্রায়ও শঙ্খধ্বনির প্রয়োজন হয়; কাড়া-নাকাড়া, শিঙ্গা, দামামা, বিউগল প্রভৃতি যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র। অতীতে ঢোল-সহরত করে সরকারি নির্দেশ জারি করা হতো।
কতক পেশায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যেমন সাপুড়েরা তুবড়ি বাজিয়ে সাপের খেলা এবং বাজিকররা ডুগডুগি বাজিয়ে বানর-ভল্লুকের খেলা দেখায়। ফেরিওয়ালা ও সার্কাসের জোকাররা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে যথাক্রমে পণ্য ফেরি করে ও তামাসা দেখায়; জুড়ি ও খঞ্জনি বাজিয়ে বৈষ্ণব-বৈরাগী ও ভিখারিরা ভিক্ষা করে।
বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করে বাংলার লোকসমাজে নানা আচার-সংস্কারও প্রচলিত আছে। শঙ্খ ও সানাই মাঙ্গলিক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়; আবার রাতে বাঁশি বাজানো অমঙ্গলজনক বলে সাধারণ লোকের মধ্যে একটি সংস্কারও প্রচলিত আছে।
বাংলাদেশে লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বহু প্রাচীন। খিস্টীয় পঞ্চম শতকে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখে এ দেশকে সঙ্গীত ও নৃত্যের দেশ বলে আখ্যায়িত করেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত পাহাড়পুর-ময়নামতীর প্রস্তরফলক ও পোড়ামাটির চিত্রে নৃত্য ও বাদ্যরত মনুষ্যমূর্তি পাওয়া গেছে। এতে কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, মৃদঙ্গ, বাঁশি, মৃৎভান্ড প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের চিত্র দেখা যায়। ঢাক, ডম্ফ, ডমরু প্রভৃতি আনদ্ধ এবং শিঙ্গা, বাঁশি, তুবড়ি প্রতৃতি শুষির যন্ত্রকে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর অবদান বলে মনে করা হয়। নবম-একাদশ শতকে রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে গীত-নট-নৃত্য-বাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। চর্যার তিনটি পদে মোট সাতটি বাদ্যযন্ত্রের নাম আছে বীণা, পটহ, মাদল, করন্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডম্বরু। এগুলির মধ্যে পটহ, মাদল, করন্ড, কসালা ও দুন্দুভি বিবাহোৎসবে বাজানো হতো। এতে বীণা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, শুকনো লাউয়ের খোলের সঙ্গে তাঁতের (সুতার) তার দিয়ে তৈরি এ যন্ত্র ‘সারি’ বা ছড় দিয়ে বাজানো হয়।
আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে রচিত ধর্মপূজার গ্রন্থ শূন্যপুরাণে বিয়াল্লিশ প্রকার যন্ত্রের উল্লেখ আছে, যেমন: ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডম্বরু, দুন্দুভি, বরঙ্গ, ভোর, ধীরকালি, শঙ্খ, শিঙ্গা, ঘণ্টা, জয়ঢাক, দামামা, খমক প্রভৃতি। এগুলির অধিকাংশই ধর্মপূজা উপলক্ষে বাজানো হতো। মধ্যযুগে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য (খ্রি ১৩শ-১৮শ শতক) গীতাকারে পরিবেশিত হতো। ওইসব কাব্য এবং চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে ততাদি চার শ্রেণির ৬৬টি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে, যথা: তত রবাব, সপ্তস্বরা, স্বরমন্ডল, রুদ্রবীণা, মধুস্রবা, খমক, দোতারা, পিণাক, পিণাকী ইত্যাদি; শুষির সানাই, শিঙ্গা, মুহরী (মধুকরিকা), উপাঙ্গ, করনাল, বিষাণ, শাঁখ (শঙ্খ), তুরি, বেণু ইত্যাদি; ঘন করতাল, মন্দিরা, ঘণ্টা, ঝাঁঝর, কাঁসর ইত্যাদি এবং আনদ্ধ দুন্দুভি, ডিন্ডিম, মৃদঙ্গ, জয়ঢাক, বীরঢাক, কাড়া, ডমরু, পটহ, দগড়, পাখোয়াজ, ডম্ফ, ভেরি, ঢাক, ঢোল, মর্দল, জগঝম্প, ডম্বুরু, খঞ্জরি ইত্যাদি। মঙ্গলকাব্যের যুগশেষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞের প্রচেষ্টায় বীণা, সারিন্দা, তানপুরা, এসরাজ (আশুরঞ্জনী), চন্দ্রসারং, মনোহরা, সরোদ, একতারা, সেতার, সুরমন্ডল, সুরবাহার, বাঁশি, খটতাল, করতাল, কাঠকরতাল, তবলা-বাঁয়া, কলিজা খাউড়ি, ঢোলক, শ্রীখোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। চৌদ্দ শতকের বৈষ্ণবকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মুরলী বা মোহনবাঁশি ছাড়াও করতাল ও মৃদঙ্গের কথা আছে; শেষের দুটিকে কৃষ্ণের নাচের তালবাদ্য বলা হয়েছে। ষোলো শতকে চৈতন্যদেবের প্রবর্তনায় কীর্তন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার প্রধান বাদ্যযন্ত্র ছিল খোল, করতাল ও মন্দিরা।
মধ্যযুগে ভারতীয় সঙ্গীতকলায় মুসলমানদের অবদান অনেক। সুফি সাধকদের সাধন-ভজনে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। রাজসভায়ও বিনোদনমূলক নৃত্য-গীত-বাদ্যের ব্যবস্থা ছিল এবং তাতে অনেক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহূত হতো; মুসলমান রচিত কাব্য, বিশেষত রাগতালনামায় এর বর্ণনা আছে। ডফ, সানাই ও নহবত জাতীয় যন্ত্র মুসলমানদেরই আবিষ্কার।
ইংরেজদের আগমনের পরে এদেশে পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, ফ্লুট, বিউগল, বেঞ্জু ইত্যাদি পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র। শহর-গ্রাম সর্বত্র হারমোনিয়াম এখন একটি সাধারণ বাদ্যযন্ত্র এবং এ দিয়েই সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি হয়।