ইথিওপিয়া (আমহারীয়: ኢትዮጵያ, ʾĪtyōṗṗyā, এই শব্দ সম্পর্কেশুনুন (সাহায্য·তথ্য), আফার ভাষায়: Itiyoophiyaa, গিয়েজ: ኢትዮጵያ, ওরোমো ভাষায়': Itoophiyaa,সোমালি ভাষায়: Itoobiya, তিগ্রিনিয়া ভাষায়: ኢትዮጵያ)) উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। এর পূর্ণ সরকারি নাম ইথিওপিয়া যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। দেশটি "আফ্রিকার শিং" তথা সোমালি উপদ্বীপ অঞ্চলটিতে অবস্থিত। ইথিওপিয়ার উত্তর সীমান্তে ইরিত্রিয়া, উত্তর-পূর্বে জিবুতি, পূর্বে সোমালিয়া, দক্ষিণে কেনিয়া, পশ্চিমে দক্ষিণ সুদান ও উত্তর-পশ্চিম সীমানায় সুদান। এর আয়তন প্রায় ১১,২৭,১২৭ বর্গকিলোমিটার (বাংলাদেশের প্রায় ৮ গুণ)। এখানে প্রায় ১০ কোটি ৫০ লক্ষ লোকের বাস; এটি আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল রাষ্ট্র (নাইজেরিয়ার পরেই)। দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম নগরীর নাম আদ্দিস আবাবা; অন্যান্য প্রধান নগরীগুলি হল দিরে দাওয়া, নাজরেত, গোন্দের, দেসে এবং মেকেলে। অতীতে আবিসিনিয়া নামে পরিচিত এই দেশটি সমগ্র ইতিহাস জুড়েই বিদেশী পরাশক্তির শাসন থেকে স্বাধীন ছিল, যা দেশটির জাতীয় ঐক্যের অন্যতম ভিত্তি।[৬] আধুনিক ইথিওপিয়া রাষ্ট্রটি ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। এখানে একটি দুইকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা আছে; রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান।
ইথিওপিয়া একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, এর কোনও সামুদ্রিক উপকূল নেই। ইথিওপিয়ার মধ্যভাগ ও উত্তরভাগে উচ্চভূমি এবং পূর্বে ও পশ্চিমে নিম্নভূমি। মধ্যভাগের উচ্চ মালভূমিকে ভেদ করে মহা গ্রস্ত উপত্যকা নামের নিম্নভূমিটি দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে চলে গিয়েছে এবং একে পূর্ব উচ্চভূমি ও পশ্চিম উচ্চভূমিতে বিভক্ত করেছে। মহা গ্রস্ত উপত্যকার পূর্বের উচ্চভূমির পূর্ব দিকে মরুময় নিম্নভূমি এবং উত্তর-পশ্চিমে পার্বত্য অঞ্চল অবস্থিত। ইথিওপিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ রাস দেজেন পর্বতের উচ্চতা ৪৬২০ মিটার। উচ্চভূমির জলবায়ু মৃদু, তবে নিম্নভূমিগুলিতে জলবায়ু অপেক্ষাকৃত উষ্ণ। বছরে দুইটি বর্ষাকাল আছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই দেশটিতে ভয়াবহ খরার সৃষ্টি হয়। উঁচু পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে তুহিন জমাট বাঁধে ও তুষারপাত হয়।
ইথিওপিয়ার সিংহভাগ এলাকাই তৃণভূমিতে আচ্ছাদিত। উচ্চভূমিগুলিতে ক্রান্তীয় অরণ্যের দেখা মেলে, তবে কৃষিক্ষেত্র নির্মাণের জন্য অনেক অরণ্য নিধন করা হয়েছে। ইথিওপিয়াতে অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী আছে, যেগুলিকে জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত অঞ্চল সৃষ্টি করে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে ওয়ালিয়া আইবেক্স নামের এক প্রজাতির পাহাড়ি ছাগল, সিমিয়েন প্রজাতির খেঁকশিয়াল ও জেলাদা প্রজাতির বানর উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইথিওপিয়াতে সিংহ, হাতি, চিতাবাঘ, জেব্রা, মহিষ, গণ্ডার ও জিরাফ আছে, যেগুলির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।
ইথিওপিয়াতে প্রায় ৮০টি ভিন্ন জাতির লোক বাস করে এবং এরা প্রায় ৯০টি স্বতন্ত্র ভাষায় কথা বলে, যেগুলির অনেকগুলির আবার একাধিক উপভাষা আছে। জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ওরোমো জাতি এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৭%) আমহারা জাতির লোক। অন্যান্য জাতির মধ্যে সোমালি, তিগ্রে ও সিদামা জাতি উল্লেখযোগ্য। আমহারীয় ও ওরোমো ভাষা দেশটির সবচেয়ে বেশি প্রচলিত দুইটি ভাষা; এছাড়া তিগ্রিনিয়া, গুয়ারাগিঙ্গা, সোমালি ও আরবি ভাষা গুলিও উল্লেখ্য। ওরোমো সর্বাধিক ব্যক্তির মাতৃভাষা হলেও বিভিন্ন জাতির লোক আমহারীয় ভাষাতেই ভাবের আদান প্রদান করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারও এই ভাষাই ব্যবহার করে। অন্যদিকে সুপ্রাচীন গে-এজ ভাষা (ও গে-এজ লিপি) ইথিওপীয় খ্রিস্টান গির্জার ধর্মীয় ভাষা হিসেবে এখনও গুরুত্বপূর্ণ।[৭] ইথিওপিয়ার জনগণের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৩%) লোক খ্রিস্টান, এবং এদের সিংহভাগ ইথিওপীয় প্রথাগত খ্রিস্টান মন্ডলীর সদস্য, বাকীরা প্রতিবাদী মন্ডলীর সদস্য। ইথিওপিয়াতে খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। তবে বর্তমানে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তিন-চতুর্থাংশ লোক গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে উচ্চভূমি অঞ্চলে বাস করে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকার ইথিওপিয়াতে আফ্রিকার সমস্ত দেশের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যাক ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে।[৮]
ইথিওপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির একটি। মাথাপিছু আয় মাত্র প্রায় ১ হাজার ডলার। দেশের অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। কিন্তু অনুর্বর জমি, যুদ্ধের কারণে অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং কিছু বছর পর পর ভয়াবহ খরার কারণে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি দুরূহ। ভুট্টা, আখ, গম, যব ও জোয়ার এখানকার প্রধান খাদ্যশস্য। কিন্তু দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং খাদ্য সাহায্যের উপর বহির্বিশ্বের উপরে অতি-নির্ভরশীল। ইথিওপিয়াতে উৎপাদিত কফি ও পশুচর্ম বিদেশে রফতানি হয়। গবাদি পশু, ভেড়া ও ছাগল থেকে মাংস ও চামড়ার চাহিদা পূরণ হয়। শিল্পখাতের আয়তন অত্যন্ত ছোট। এখানে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, চামড়ার দ্রব্য ও রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। এছাড়া খনিতে লবণ, সোনা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলন করা হয়। ইথিওপিয়ার মুদ্রার নাম বির (১ বির = ১০০ সেন্ট)। ২০১০ সালে এসে দেশটি কেনিয়াকে ছাড়িয়ে পূর্ব আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়।[৯][১০][১১] এত উন্নতি সত্ত্বেও ইথিওপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির একটি।[১২] এখানে দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিক্ষা (সাক্ষরতার হার মাত্র ৫১%) ও স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা আজও বিরাট কিছু সমস্যা।[১৩] মানব উন্নয়ন সূচকে দেশটির অবস্থান দেশের তালিকার শেষ চতুর্থাংশেই ওঠানামা করে।