দেশের চার অঞ্চলে একসঙ্গে চলমান বন্যা দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছে। ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬ জেলায় শুরু হয়েছে বন্যা। রোববার পর্যন্ত ১১ জেলা ছিল বন্যাকবলিত। বর্তমানে দেশের ১৪টি নদী ২২ স্থানে প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার উপরে। আজ দুপুরের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলের আরও কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে চলে যেতে পারে।
ADVERTISEMENT
এতে এ দুই অঞ্চলের আরও কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং আপার মেঘনা অববাহিকার নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। এর মধ্যে প্রথম দুই অববাহিকায় আগামী তিন দিন আপার মেঘনা নদী অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টা বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তবে আশার দিক হচ্ছে, তিস্তা ও ধরলা নদীতে পানির সমতল হ্রাস পেতে পারে। এতে কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। অনেকে ইতোমধ্যে বাড়িঘর ছেড়ে গরু-ছাগল নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি ঢলে মুহুরি নদীর ৬ স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর ১২ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) সোমবার এক বুলেটিনে বলেছে, বর্তমানে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজবাড়ী, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ফেনী জেলায় বন্যা চলছে। এসব জেলার মধ্যে প্রথম তিনটিতে বন্যার পানি নামা শুরু করতে পারে। শেষের চার জেলায় বন্যার পানি নাও বাড়তে পারে। কিন্তু বাকিগুলোয় বানের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী মানিকগঞ্জের আরিচা, পদ্মা নদী মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল ও মাওয়া এবং কুশিয়ারা নদী শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। পানি বাড়ছে দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের নদী সাঙ্গু, হালদা, মুহুরি এবং মাতামুহুরিতে। এ কারণে বান্দরবান ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
সংস্থাটির বুলেটিনে আরও বলা হয়েছে, ১৪ নদীর পানি বইছে বিপৎসীমার উপরে। এগুলো হচ্ছে : ধরলা, তিস্তা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, পুরাতন সুরমা, মুহুরি, গুড় এবং সোমেশ্বরী। সংস্থাটি সারা দেশে ১০১ স্থানে নদীর প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে। এগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে অন্তত ২২ স্থানে বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে নদী। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৭৮ স্থানে পানিপ্রবাহ বেড়েছে।
দেশের ভেতরে ও বাইরে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের পানিই এই বন্যার কারণ। এফএফডব্লিউসি এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশের ভেতরে ১৫টি স্থানের গত ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত রেকর্ডে দেখা যায়, ১৫তম স্থানে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এটি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড দেখা যায় লালাখালে ১৬০ মিলিমিটার। এ ছাড়া পঞ্চগড়, নোয়াখালী, টেকনাফ, ঠাকুরগাঁও, জাফলং, শেরপুর-সিলেট, ডালিয়া, ছাতক, শেওলা, দিনাজপুর, পরশুরাম, চাঁদপুর বাগান, সাতক্ষীরা সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়।
অন্যদিকে দেশের বাইরে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ১৮৪ মিলিমিটার আর আসামের শিলচরে ৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সিকিমে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কমেছে। যে কারণে তিস্তা ও ধরলায় বন্যার পানিপ্রবাহ হ্রাসের আশা করছেন বন্যা বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দ্বিতীয় ধাপের এই বন্যা প্রথম ধাপের তুলনায় আরও আগ্রাসী। কেননা, উজানে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। আরও অন্তত এক সপ্তাহ ধরে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। জনগণকে রক্ষায় ত্রাণ ও পুনর্বাসনে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
যুগান্তর ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সব কটি নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। রোববার বিকাল ৩টা থেকে সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৩৭ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬৭ সেমি., তিস্তার নদীর পানি এ সময় ১৩ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৫ সেমি. ও ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ৪১ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৩ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ মাসের প্রথম পর্যায়ের বন্যায় সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার নদীতীরবর্তী ও চরাঞ্চল থেকে যেসব এলাকা থেকে পানি নেমে গিয়েছিল সেগুলো আবার নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, গাইবান্ধার ৪ উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন পুনরায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ওইসব এলাকার ১ লাখ ২২ হাজার মানুষের ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। জেলা প্রশাসন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪ উপজেলার বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য সোমবার নতুন করে ১০০ টন চাল, ৪ লাখ টাকা, ১ হাজার ৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও শিশুখাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলার ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রোববার মধ্যরাতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি সর্বোচ্চ বিপৎসীমা ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে সোমবার বিকালে তা ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে। সোমবার সদর উপজেলার মোগলহাটের শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।