বান্দরবান বাস স্টেশন থেকে চান্দের গাড়ি ভাড়া করা ভাল, ভাড়া হবে ৩০০০-৩৫০০ টাকা।
সকাল ৮ টার দিকেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমরা কাইক্ষ্যাংছড়ি পৌঁছে যাই। এখান থেকে রুমা যাবার জন্য বোট ভাড়া করি ১২০০ টাকায়। অবশ্য নৌকায় যেতে রুমা বাজার, ভাড়া হবে জনপ্রতি ৪০ টাকা। চাইলে বান্দরবান থেকে সরাসরি নৌকায় রুমা বাজার যাওয়া যায়, কিন্তু সে জন্য সময় লাগবে ৮ ঘণ্টা। আর কাইক্ষ্যাংছড়ি থেকে সময় লাগে মাত্র ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট।
সাঙ্গু নদীর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা নৌকায় যাচ্ছি সাঙ্গু পাড়ে মাঝে মাঝে রয়েছে আদিবাসীদের জনবসতি এছাড়া পুরোটাই পাহাড় আর নদীর অপূর্ব মিলন দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। একটু পরপরই দেখা যায় পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এসেছে প্রাকৃতিক ঝর্ণা। রুমা বাজার যাবার পথে আনসার ক্যাম্পে নাম নিবন্ধন করি আমাদের দলের।
আমরা যখন রুমা বাজার পোঁছি তখন সকাল ১০ টা। রুমা বাজারে স্থানীয় হোটেলে খাবারের পর্ব চুকিয়ে বগালেক যাবার জন্য তৈরি হই। আর রুমার পর থেকে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। তাই পরিবারে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেই চিন্তা না করতে।
এরই ফাঁকে রুমা বাজার থেকে মুরগিসহ কিছু কাঁচা বাজার করি বগালেকে ক্যাম্প ফায়ারের জন্য। রুমায় একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে নির্ধারিত ১৫০ টাকা ফি দিয়ে বগালেক যাবার জন্য একজন নিবন্ধিত গাইড ঠিক করি। তারপর গাইডসহ রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্পে গন্তব্যসহ নাম নিবন্ধন করে বগালেক যাবার জন্য চান্দের গাড়ি ভাড়া করি ২০০০ টাকায়, এছাড়া জন প্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা।
বান্দরবান থেকে আসার সময় চান্দের গাড়িতে চড়েছিলাম আবারও যাচ্ছি কিন্তু রুমা থেকে বগালেক যেতে পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা-খাড়াখাদ আরও বেশি। কখনো ৭০ ডিগ্রি এঙ্গেলে রাস্তা পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে বা আবার কখনো ঢাল বেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। পুরো ভয়ানক থেকে ভয়ানক বন-জঙ্গল রাস্তার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে পাশে কিছু আদিবাসীদের দেখা যায়। অবশেষে চান্দের গাড়ি যেখানে নামিয়ে দিলো সেখান থেকে যাত্রা শুরু করলাম ১ ঘণ্টার হাঁটা পথে।
পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথে হেঁটে ওপরে উঠলেই বগালেক । ওপরে ওঠার সময় হোচট খেয়ে পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হাতে লাঠি নিয়ে খুব সাবধানে এগুচ্ছি, দুই বার বিশ্রাম নিয়ে থেমে থেমে ওপরে বগা লেকের চুড়ায় উঠতেই (২৭০০ ফুট) মুগ্ধ নয়নে আশেপাশের পাহাড় ও আকাশে মিশে যাওয়া দেখতে পেলাম। আর ঠিক পেছনেই তিনটি পাহাড়ের কোলে বগালেকটি, পাশেই ছিমছাম সুন্দর একটি পাড়া বা গ্রাম দেখা গেল। কিছু লোক লেকের পানিতে গোসল করছিল। বগালেকে থাকার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে স্থানীয় এক লোকের বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
এছাড়া বগালেকে থাকতে হলে বান্দরবান পৌঁছেই বুকিং দিতে হয় ফোন নম্বর: ০১৫৫৭০৬১৬৫৭, ০১৮২৮৪৯৮৭৩০। জন প্রতি থাকা খরচ ১৫০ টাকা করে। তাদের এখানেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। থাকার জায়গায় আমাদের ব্যাগগুলো রেখেই লেকের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অসাধারণ স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানিতে ১ ঘণ্টা সাতার কেটে ওঠার পর সন্ধ্যা নেমে এলো। এখানে রাতের অন্ধকার খুবই ভয়াবহ কিন্তু আকাশে চাঁদ থাকায়, স্নিগ্ধ অলোয় পুরো জায়গাটায় মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়। আর বিদুৎ নেই সোলার প্যানেল দিয়ে লাইট জ্বালানো হয় ও মোবাইল চার্জ করা যায়, বগালেকে শুধুমাত্র রবি ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে।
সারাদিনের ভ্রমণে প্রচন্ড ক্ষুধার্থ সবাই। তাই রুমা থেকে কিনে আনা মুরগি ও কাঁচা বাজার নিয়ে রান্না শুরু করে দেই নিজেরাই। গাইডকে বললে, স্থানীয়দের দিয়ে রান্না করে দেয়। খাওয়া-দাওয়ার পর বগালেকের পাশেই একটি মাঠে আরও কিছু টুরিস্ট গিটার নিয়ে গানের আসর বসিয়েছে মায়বী আলোতে। রাতে এখানে সময় বোঝা যায় না। আমরা রাত ১১ টার দিকেই ঘুমোতে গেলাম।
সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করলাম। পাহাড়ে ও লেক এর পাশে মেঘগুলো কুয়াশার মত জমে রয়েছে। এতো সুন্দর, এ যেন অন্য ভূবন! এবার আমরা দল বেধে চিংড়ি ঝর্ণার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। বগালেক থেকে ঘণ্টা খানিক হাঁটার পর খাড়া পাহাড় ও জঙ্গল ভেদ করে আমরা অবশেষে চিংড়ি ঝর্ণার দেখা পাই। পথে আরও ৬-৭ টি ছোট ঝর্ণা ফেলে এসেছি, কিন্তু চিংড়ি ঝর্ণা অনেক বড়। চিংড়ি ঝর্ণার পরেই আছে তার চেয়েও বড় ঝর্ণা জাদিপাই এরপরই কেওকারাডং এর চূড়া। আমরা চিংড়ি ঝর্ণা দেখেই আবার বগালেকে ফিরে এলাম। তারপর বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রুমা হয়ে বান্দরবন শহরে আসতে আসতে আমাদের রাত হয়ে গেল। শহরের একটি হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন একটি চান্দের গাড়ি ভাড়া করে শহরের আশেপাশে স্বর্ণ মন্দির, শৈল প্রপাত, মেঘলা দেখে রাত্রে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।