সমস্ত প্রশংসা মহান রব্বুল আলামীনের জন্য যিনি আমাদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে শেষ নবীর উম্মত ও একমাত্র তাঁরই অনুসারী হিসাবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর সালাম ও দরূদ পেশ করছি আমাদের শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), তাঁর পবিত্র বংশধর, তাঁর সত্যনিষ্ঠ সাথী গণের প্রতি।
অতঃপর আমি ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে ও অনুরূপ পাঠকবর্গকে যারা ইন্টারনেটের বাহারি চাকচিক্য ছেড়ে তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে ইসলামের মাযহাব সম্পর্কে জানার ও বুঝার লক্ষ্যে আমাদের এই ক্ষুদ্র পরিসরে অংশ গ্রহণ করেছেন।
আলোচনা শুরুতেই আমি আপনাদেরকে অবহিত করছি যে আমাদের জ্ঞান হচ্ছে সীমিত, নবী রাসূল ও মাসুম ব্যক্তি বর্গেল জ্ঞান হচ্ছে নির্ভুল আর আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে অসীম ও বাস্তব হাকিকত। অতএব আমাদেরকে আমাদের এ সীমিত জ্ঞান দিয়েই নির্ভেজাল ইসলামকে জানা ও বাঝুর চেষ্টা চালিয়ে সঠিক আমল ও আখলাক সম্পর্কে অবগত হতে হবে এবং সে মাফিক আমল করারও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য এটিই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় কর্তব্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে এমন সব রীতিনীতির প্রচলন ঘটেছে ও ঘটছে যেগুলো আমাদের পরস্পরকে এক কাতারে শামিল হতে বাধা প্রদান করছে। আমাদের মত ইসলামের অনুসারী সকলেই নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবী করার পরেও কেন এই বিভিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতা? অথচ ইসলামই হচ্ছে আমাদের একমাত্র ধর্ম, সঠিক পথের দিক নির্দেশক হিসেবে আমাদের নবীও একজন, আমরা একই কালিমা পাঠ করি, আমাদের কিবলা এক এবং আমাদের কোরআনও এক। অতএব কোন পথ অবলম্বন করলে আমরা এক পথে চলতে পারবো আমাদেরকে তা ভেবে দেখা দরকার।
বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যখন আমেরিকা ও ইসরাইলসহ পাশ্চাত্য পন্থী সম্প্রদায় ইসলামেকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মুসলমানদের মাঝে সর্বদাই বিভেদ ও বিশৃংখলা লাগিয়ে আসছে, যাতে আমাদেরকে একে অপরেরর বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে সবচেয়ে বেশি সুবিধা তারা অর্জন করতে পারে।
মাযহাবগত মতভেদ
কোন মাসআলা নিয়ে কথা উঠলে আমরা কেউ বলছি : আমাদের মালেকি মাযহাবে এরূপ নেই, কেউ বলছি আমাদের হাম্বলি মাযহাবে এমন বলা হয়নি, আমাদের হানাফি মাযহাবে এরূপ আছে, আমাদের শাফেয়ী বা জাফরী মাযহাবে এভাবে বলা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কি ইসলামের দাবী ছিল এটাই? একজন মুসলিমের দাবী কি এরূপ হওয়া উচিত? তাহলে কি প্রশ্ন আসে না যে, পাঁচ ইমাম[1] বা অন্যান্য ইমামগণের আগমনের পূর্বের লোকেরা কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন? মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ‘র ওফাত হলো এগারো হিজরিতে আর ইমাম –আবু হানীফা (রহঃ)– এর মৃত্যু হলো হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দির শেষার্ধে, ইমাম জাফর সাদিক (আল্লাহ তার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন) ’র ওফাত ১৪৮ হিজরিতে অতঃপর অন্যান্য ইমামগণ জন্ম গ্রহণ করেন। এ মধ্যবর্তি সময়ের লোকেরাও কি কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন? কোন মাযহাবের অনুসারী থাকলে সে মাযহাবটির নাম কি ছিল? নিঃসন্দেহে প্রত্যেক বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি উত্তর দিবেন নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ‘র একমাত্র অনুসরণই ছিল তাদের মাযহাব, তাহলে সেই সময় অতীত হয়ে যাবার পরে কিভাবে আমরা নিজেদেরকে রাসূল (সাঃ) এর অনুসারী না বলে, আমি অমুক ইমামের অনুসারী আর সে অমুক ইমামের অনুসারী এরূপ কথা বলছি? তবে মুসলিম উম্মাহের এরূপ মাযহাবগত বিভক্তির কথা স্বয়ং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ‘ই বলে গেছেন: তিনি বলেছেন আমার ভাই মূসা (আঃ) ’র পরে তার উম্মত অর্থাৎ বনি ইসরাঈল বিভক্ত হয়েছিল ৭১ টি ফেরকায় যার একটি ছিল বেহেশ্তি, আমার ভাই ঈসা (আঃ) ‘রপরে তার উম্মত বিভক্ত হয়েছিল ৭২ টি ফেরকায় যার একটি ছিল বেহেশ্তি, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ ফেরকায় যার মধ্যে মাত্র একটি ফেরকাই হবে বেহেশ্তি এবং বাকি সব হবে জাহান্নামি (সহীহ মুসলিম হা/১৯২০ ; তিরমিযী হা/২২২৯, তাফসীরে আহসানুল হাদীস, খন্ড ২, পৃ ১৫৮; তাফসীরে জামে’, খন্ড ১, পৃ ৫২৬; মাখজানুল এরফান, দার তাফসিরে কোরআন, খন্ড ৫, পৃ ১৬৫)। অতএব বিষয়টি কি ভেবে দেখার নয়? অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত ও অনুসন্ধান করা উচিত যে, কোন মাযহাব অধিকতর সত্ব পথে রযেছে? তবে আমার এ কথার দ্বারা কোন মাযহাবের অনুসারীকেই খাটো করে দেখা হচ্ছে এরূপ ভাবা ঠিক হবে না। কারণ তা গবেষণামূলক বিষয় অর্থাৎ আলেমদের কাজ।
কোন মাযহাবের ফতোয়া অধিকতর সঠিক
যদি কেউ বলেন : অবশ্যই আমাদের একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা জরুরী, তাহলে যিনি এ কথা বলবেন তাকে বলব : এখানে আজকে যারা সমবেত হয়েছি আমাদের মধ্য থেকে পাঁচ জন পাঁচ মাযহাবের অনুসারী হিসেবে যদি দাবী করি আর প্রত্যেকেই যদি বলি আমার মাযহাব সঠিক আমার মাযহাব সঠিকআর আমার মাযহাবই হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাহলে কি প্রত্যেকের দাবী অনুযায়ী হক্ব পাঁচটি হয়ে যায় না? এভাবে একটি মাসআলার ক্ষেত্রে পাঁচ মাযহাবের পাঁচ জন পাঁচ ধরণের সিদ্ধান্ত দিলে পাঁচটি মতই কি হক্ব হিসেবে গণ্য হবে? এভাবে ইসলাম কি পাঁচটি হয়ে যাচ্ছে না? তাহলে আমরা কি ইসলামকে ভাগ করে ফেলছি না? না ভাই তা হতে পারে না, বরং তার মতটিই হক্ব হিসেবে ধরা যাবে যার মতটি বিশুদ্ধ ও সহীহ দলীল নির্ভরশীল। প্রত্যেককেই প্রমাণ উপস্থিত করতে হবে। আর দলীলের ভিত্তিতে এক জনের মতই সঠিক হবে, আর অন্যদেরকে সঠিক দলীলের মতকে মেনে নিতে হবে। আপনি যদি আপনার মাযহাবকে হক্ব মনে করেন, তাহলে আপনাকে আপনার মাযহাবের স্বপক্ষে দলীল উপস্থাপন করতে হবে। অন্যথায় আপনি কারো মুখে শুনে দলীল ছাড়া কথা বলবেন তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
হক্বপন্থি দল মাত্র একটি
হক্বপন্থি দল হবে একটিই। তাইতো রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন : “আমার উম্মাতের মধ্য থেকে একটি দলই হক্বের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে…।” তিনি আরো বলেছেন : “আমি আমার উম্মাতের পথভ্রষ্টকারী (বিদআত ও ফিসক-ফুযুরের দিকে আহ্বানকারী) ইমামদের (আলেমদের) ব্যাপারে ভয় করছি।” আবু দাউদ হা/৪২৫২ ; জামেউস সাগীর হা/২৩১৬। অতএব এ শ্রেনীর আলেম যে বর্তমান যুগে নেই তা বলা যাবে না, বরং আছে এটিই সত্য। এ জন্যই আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য প্রতি নামাযে অন্ততঃ দুই বার পড়তে বলেছেন :