তিনি এক অদ্ভুত রশ্মি আবিষ্কার করেছেন, যা শরীরের মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত পৌঁছায়। তাকে আমরা বলি রঞ্জনরশ্মি বা এক্সরে। তার নাম উইলহেম রন্টজেন।
উইলহেমের জন্ম হয়েছিল ১৮৪৫ সালের ২৭ মার্চ জার্মানির রাইন প্রদেশের লেনেপ অঞ্চলে। তার পুরো নাম উইলহেম কনরাড রন্টজেন। তিনি ছিলেন কাপড় বিক্রেতা পিতামাতার একমাত্র সন্তান। জন্ম জার্মানিতে হলেও তার শৈশব কেটেছিল বর্তমান নেদারল্যান্ডসের আপ্লেডুর্ন শহরে সেখানে তাকে ভর্তি করা হয় মার্টিনাস হার্মান ফন ডুর্নের বোর্ডিং স্কুলে। ১৮৬২ সালে ভর্তি করা হয় ইউত্রেক্তের এক কারিগরি স্কুলে।
উইলহেম নিজ প্রচেষ্টায় মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ইউত্রেক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৮৬৫ সালে। পাঠ্যবিষয় হিসেবে পছন্দ করেন পদার্থবিদ্যা। কিন্তু এখানে থিতু হতে পারলেন না। যখন পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যায়, তখন তিনি এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছিলেন।
তার পরিত্রাতা হিসেবে হাজির হয় বিখ্যাত জুরিখ পলিটেকনিক। জুরিখ পলিটেকনিকে ভর্তি হতে কোনো ছাত্রের পূর্ব শিক্ষাজীবনের কাগজপত্রের প্রয়োজন ছিল না। শুধু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই সেখানে অধ্যয়নের সুযোগ মিলত।
তিনি সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা হয় জুরিখে। সেখানে তিনি যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। এখানে তিনি তার কৈশোরের যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। ১৮৬৯ সালে তিনি গবেষণা জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ডক্টরেট অর্জনের পর তার প্রশিক্ষক কুন্ড তাকে সহকারী হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। উইলহেমের জন্য এই প্রস্তাব ছিল স্বপ্নের মতো। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। প্রায় পাঁচ বছর সহকারী হিসেবে কাজ করার পর তিনি তার জীবনের প্রথম স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব পান।
স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এক বছর পর তিনি স্ট্রাসবুর্গ ছেড়ে হেনহ্যাম কৃষি একাডেমির পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তবে এখানে এক বছরের বেশি কাজ করতে পারলেন না। তাই তাকে আবার স্ট্রাসবুর্গে ফেরত আসতে হয়। স্ট্রাসবুর্গে তিনি এবার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৭৯ সালে তাকে গিসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
১৮৮৮ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে এখানে যোগ দেন। এখানে কর্মরত অবস্থায় তিনি তার বিশ্ব কাঁপানো রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। সাধারণ উইলহেমের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প এখানেই রচিত হয়েছে।
যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন তখন তার ডাক পড়ে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। জার্মান সরকারের বিশেষ অনুরোধে তিনি সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দিতে রাজি হন। জার্মানিতে জন্ম নেয়া উইলহেম শেষ পর্যন্ত ফিরে যান তার জন্মভূমিতে।
একদিন তিনি তার স্ত্রী আনাকে তলব করলেন। উদ্ভ্রান্ত বিজ্ঞানী তার স্ত্রীর হাত সেই রশ্মির যাত্রাপথে মেলে ধরলেন। তখন আনার হাতের আঙুলে বিয়ের আংটি ছিল। উইলহেম দেখলেন, দেয়ালে একটি ভৌতিক হাতের দৃশ্য ভেসে উঠেছে।
সেই হাতের মাংসগুলো স্বচ্ছ হয়ে গেছে। কিন্তু হাতের অস্থিগুলো স্পষ্ট চিত্রিত হয়ে আছে। আর বিয়ের আংটির স্থলে গাঢ় কালো রঙের ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম রন্টজেনোগ্রাম। এই দৃশ্য দেখে তার স্ত্রী আনাও ভয়ে শিউরে উঠলেন।
উইলহেম বুঝতে পারলেন, তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ রশ্মি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। যেহেতু সেই রশ্মির বৈশিষ্ট্য সবার অজানা ছিল, তাই তিনি এর নাম দিলেন ‘এক্স-রে’। অনেকে একে রন্টজেন রশ্মি হিসেবে ডাকা শুরু করে।
তার এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
১৯২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৭৭ বছর বয়সে এই মহান বিজ্ঞানীর মহাপ্রয়াণ ঘটে।