গ্যালিলিও ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইতালির টুস্কানিতে অবস্থিত পিসা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ভিনসেঞ্জো গ্যালিলি গণিতজ্ঞ এবং সংগীতশিল্পী ছিলেন। ভিনসেঞ্জো ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্ম নেন। তার মায়ের নাম গিউলিয়া আমানাতি (Giulia Ammannati)। গ্যালিলিও ছিলেন বাবা মায়ের সাত সন্তানের (কারো কারো মতে ৬) মধ্যে সবার বড়ো। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীও ছিলেন।
বেশ অল্প বয়স থেকে গ্যালিলিওর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সাধারণ শিক্ষার পর তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হন, কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন সেখানেই তার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়। তার পরেও ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য একটি পদ পান এবং সেখানে গণিত পড়ানো শুরু করেন। এর পরপরই তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান এবং সেখানকার অনুষদে জ্যামিতি, বলবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। ওই সময়ের মধ্যেই তিনি বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন।
গ্যালিলিও এবং মারিনা গ্যামবা তিন সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। গ্যালিলিও একজন নিবেদিত রোমান ক্যাথলিক ছিলেন বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে তা মেনে নিলে তাঁর বিবাহ বহির্ভূত এই যৌনাচার অনেকটাই অবাস্তব মনে হয়। তাদের দুই মেয়ে (ভার্জিনিয়া ও লিভিয়া) এবং এক ছেলে (ভিনসেঞ্জিও) জন্মেছিল। বিবাহ বহির্ভূত সন্তান উৎপাদনের জন্য তাদের দুই মেয়েকেই স্বল্প বয়সে আরসেত্রিতে অবস্থিত সান মেটিও নামক গির্জায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের দুই মেয়েকে বাকি জীবন সেখানেই অতিবাহিত করতে হয়েছিল। কনভেন্টে প্রবেশের পর ভার্জিনিয়া মারিয়া সেলেস্টি নাম ধারণ করে, তিনি-ই ছিলেন গ্যালিলিওর সন্তানদের মধ্যে সবার বড়ো। ভার্জিনিয়া সবচেয়ে আদরের সন্তানও ছিলেন এবং বাবার মেধার খানিকটা উত্তরাধিকার তিনি-ই লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল তারিখে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর সমাধি বাসিলিকা ডি সান্তা ক্রস ডি ফিরেঞ্জে গ্যালিলিওর সমাধির পাশেই অবস্থিত। লিভিয়া (জ. ১৬০১) সুওর আরকাঞ্জেলা নাম ধারণ করেন। বড়ো বোনের মতো তিনি কিছু করে দেখাতে পারেননি, জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি অসুস্থ ছিলেন। ছেলে ভিনসেঞ্জিও (জ. ১৬০৬) পরবর্তীতে বৈধ জাত্যাধিকারী হন এবং সেসটিলা বচ্চিনারিককে (Sestilia Bocchineri) বিবাহ করেন।
১৬১২ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও রোমে গিয়ে অ্যাকাডেমিয়া দেই লিন্সেই-তে যোগ দেন। সেখানে তিনি মূলত সৌর কলঙ্ক পযর্বেক্ষণ করতেন। ওই বছরই কোপারনিকাসের মতবাদের বিরোধী মতবাদ প্রচারিত হয় এবং গ্যালিলিও তা সমর্থন করেন। ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে সান্তা মারিয়া নভেলার প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে ফাদার টমাসো কাচ্চিনি (Tommaso Caccini, ১৫৭৪ - ১৬৪৮) ব্যাখ্যা সহকারে পৃথিবীর গতি সম্পর্কে গ্যালিলিওর মতবাদ বর্ণনা করেন। এরপর সেই মতবাদের ভিত্তিতে তাঁর বিচার করেন এবং ঘোষণা করেন যে, এগুলো ভয়ঙ্কর এবং ধর্মদ্রোহীতার শামিল। এধরনের অভিযোগ থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টায় তিনি রোমে যান। কিন্তু ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে কার্ডিনাল রবার্ট বেলারমাইন ব্যক্তিগতভাবে তার মামলাটি হাতে নেন এবং তাঁকে হেনস্তা করতে শুরু করেন। ধর্মীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় কোপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ধর্মীয় আইন হিসেবে কোপারনিকান জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়তে বা পড়াতে বাধ্য করা হয়। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও তাঁর বিখ্যাত বই দ্য অ্যাসাইয়ার (Saggiatore) রচনা করেন যা ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রকাশিত হয়। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রোমে ফিরে যান তাঁর রচিত একটি বই প্রকাশের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য। বইটির নাম ছিল ডায়ালগ কনসার্নিং দ্য টু চিফ ওয়র্ল্ড সিস্টেম্স। এটি এই লাইসেন্সের আওতাতেই ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্স থেকে প্রকাশিত হয়। ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে তাঁকে রোমের পবিত্র দপ্তরের (Holy Office) সম্মুখীন হতে হয়। কারণ ছিল "Congregation for the Doctrine of the Faith" (বিশ্বাসের উপদেশাবলির জন্য সমাবেশ)। আদালত থেকে তাঁকে একটি দণ্ডাদেশ দেওয়া হয় যার মাধ্যমে তাকে পূর্ববর্তী ধ্যান-ধারণা শপথের মাধ্যমে পরিত্যাগের জন্য বলা হয়। ওই দণ্ডাদেশের কার্যকরতা প্রমাণের জন্যই তাঁকে সিয়েনায় একঘরে জীবন কাটাতে হয়। এর কিছু পর ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে তাঁকে তার নিজ বাড়ি আরসেত্রিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বড়ো মেয়ের মৃত্যুর পর গ্যালিলিও অনেকটাই ভেঙে পড়েন। বড়ো মেয়ে সিস্টার সেলেস্টি (১৬০০ - ১৬৩৪) তাঁকে সবসময় সঙ্গ দিত, এই অকালমৃত্যুতে তাই গ্যালিলিও হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও লিডেন থেকে তাঁর সর্বশেষ বই টু নিউ সায়েন্সেস প্রকাশ করেন। আরসেত্রিতে ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ৮ জানুয়ারি তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার ছাত্র ভিনসেঞ্জো ভিভিয়ানি তাঁর পাশে ছিলেন।