নিকোলাস কোপার্নিকাস ১৪৭৩ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ড সম্রাজ্যের রয়েল প্রুসিয়া প্রদেশের থর্ন (আধুনিক তোরন) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কারাকোর একজন বণিক ছিলেন এবং তার মা ছিলেন তোরনের একজন ধনী বণিকের কন্যা। নিকোলাস চার ভাই বোনের মধ্যে সবার চেয়ে ছোট ছিলেন। তার বড় ভাই এন্দ্রু ফ্রনবার্গের একজন অগাস্টিয়ান কেনন ছিলেন। তার বড় বোনের নাম ছিলো বারবারা, তার মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে। তার বোন ছিলো একজন মঠবাসিনী বা সন্নাসী। তিনি ১৫১৭ সালে মারা যান। কোপার্নিকাসের আরেক বোন ক্যাথরিন যিনি কিনা তোরনের ব্যবসায়ী এবং শহরের কাউন্সিলর বার্থেল গার্টনারকে বিয়ে করেন। তাদের পাঁচ জন সন্তান ছিল। কোপার্নিকাস মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বোনের সন্তানদের দেখাশোনা করেছেন। কোপার্নিকাস কোন বিয়ে করেননি এবং তার কোন সন্তান ছিলো না। তবে ১৫৩১ থেকে ১৫৩৯ সাল পর্যন্ত তার আনা সিলিং নামে এক গৃহকর্মীর সাথে সম্পর্ক ছিলো।
পিতার পরিবার
Toruń birthplace (ul. Kopernika 15, left). Together with the house at no. 17 (right), it forms the Muzeum Mikołaja Kopernika.
কোপার্নিকাসের পিতার পরিবারের আদিনিবাস ছিল নেয়াসের কাছে সিলেসিয়া নামক একটি গ্রামে। তবে গ্রামের নাম পরবর্তিতে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে, যেমন- কপার্নিক, কোপার্নিস, কোপের্নিক এবং আজ তা কোপের্নিকি নামে পরিচিত। ১৪ শ শতাব্দীতে পরিবারটি সিলেসিয়া শহর থেকে পোল্যান্ডের রাজধানীর দিকে আসতে শুরু করে। প্রথমে কারাকাও এরপর তারা তোরণে চলে আসে। বাবা নিকোলাস সম্ভবত জনের(দাদা) বড় ছেলে ছিলেন যিনি কারাকাও থেকেই এসেছিলেন।
নিকোলাস নামটি তার পিতার নামেই নামকরণ করা হয় যিনি কিনা তামার ব্যবসায় প্রথমবারেই চমক প্রদান করেছিলেন। যার বেশিরভাগই দানজিগ এলাকাতে বিক্রি হয়। তিনি(কোপার্নিকাসের বাবা) ১৪৫৮ সালে কারাকাও থেকে তোরণে চলে আসেন। তোরন, ভিস্তুলা নদীর তীরে অবস্থিত, যেখানে দীর্ঘ ১৩ বছর যুদ্ধ হয়েছিলো। কারণ, পোল্যান্ড ও প্রাদেশিক কয়েকটি রাজ্য ও পুরুশীয়ান শহরের একটি জোট অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য টিউটোনিক আদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলো। এই যুদ্ধে হেনসেয়াটিক শহরেগুলোর মত দানজিগ এবং তোরণও পোলিশ রাজাকে(ক্যাসিমির, জাগলোন) সমর্থন করেছিলো, যারা এই শহরের ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা রক্ষায় শপথ নিয়েছিলো যা ছিলো টিউটোনিক আদেশের বিরুদ্ধে।
নিকোলাসের বাবাও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পোল্যান্ড ও টিউটোনিক আদেশের বিরুদ্ধের শহরগুলোকেও সমর্থন করে যান। ১৪৫৪ সালে তিনি পোল্যান্ডের কার্ডিনাল জাবিগাইড ওলিসনিক এবং পুরুশীয়ান শহরের মধ্যকার যুদ্ধ ঋণ পরিশোধের মধ্যস্থতা করেন। থর্নের দ্বিতীয় পর্বের চুক্তি(১৪৬৬) অনুযায়ী টিউটোনিক আদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম প্রদেশের সমস্ত দাবী প্রত্যাখান করে। কোপার্নিকাসের বাবা ১৪৬১ হতে ১৪৬৪ সালের মধ্যে জ্যোতিবিজ্ঞানী বারবারা ওয়াটজেনরোদেকে(কোপার্নিসের মা) বিয়ে করেন। ১৪৮৩ সালে তিনি(পিতা) মৃত্যুবরণ করেন।
মাতার পরিবার
কোপার্নিকাসের মা(বারবারা ওয়াটজেনরোদে) ছিলেন তোরণের রাজনীতিবীদ এবং শহরের মেয়র লুকাস ওয়াটজেনরোদে ও কাটারজিনা(ক্যাথরিন) এর কন্যা।(এটি ক্যাটারজিনা রুদিগার জেনেট মোদালিবোগ এর সূত্র অনুযায়ী)। মোদালিবোগ ছিল প্রভাবশালী একটি পোলিশ পরিবার। যা ১২৭১ সাল থেকে পোল্যান্ডের ইতিহাসের সাথে জড়িত আছে। ওয়াটজেনোরদে পরিবারটিও কোপার্নিক পরিবারের মতো সিলেসিয়া গ্রামের নিকটবর্তী সুইউনিকা থেকে এসেছিল এবং ১৩৬৩ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তরনে। তারা খুব শীঘ্রই ধনী এবং রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠে। যদিও ওয়াটজেনোরদে পরিবারটি বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে ব্যাপক পরিধি লাভ করে। এই কারণে নিকোলাসের সাথে তোরন, দানজিগ, এলব্লাগের ধনী পরিবার এবং পুরুশীয়ার কাপসজিক, ডিলায়নজিক, কোনোপাকিজ, কোসেলেকিজ উঁচু পরিবারগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিল। লিকাস এবং ক্যাথরিনের তিন সন্তান ছিল। জুনিয়র লুকাস ওয়াটজেনরোদে(১৪৪৭-১৫১২) ছিলেন একজন ওয়ার্মিয়া বিশপ, বারবারা ছিলেন জ্যোতির্বিদ। তিনি(বারবারা) মারা যান ১৪৯৫ সালে এবং ক্রিস্টিনা যিনি তোরনের ব্যবসায়ী টিডেমান ভন এলেনকে ১৪৫৯ সালে বিয়ে করেন। ক্রিস্টিনা ১৫০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
লুকাস ওয়াটজেনোরদে টিউনিক নাইটের বিরুদ্ধে ছিলে। ১৪৫৩ সালে তিনি গ্রাউডুনেজেব তোরনের প্রতিনিধিত্ব করেন ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। তের বছরের যুদ্ধের সময় তিনি প্রুশিয়ার শহরগুলোকে সমর্থন করেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করে এবং পরে তোরন ও দানজিগের রাজনীতিতে সরাসরি যোগদান করেন। তিনি লাসিন এবং মাওবার্কে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি ১৪৬২ সালে মারা যান। লুকাস ওয়াটজেনরদে জুনিয়র, কোপার্নিকাসের মামা পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি কারাকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। এছাড়াও কলগনে এবং বলগনাতেও পড়ালেখা করেছিলেন। তিনি টিউটরনিকের আদেশের বিরুদ্ধে ছিলেন।
এজন্য তার গ্রান্ডমাস্টার তাকে শয়তান বলে উল্লেখ করেন। ১৪৮৯ সালে তিনি রাজা কাসিমির(৬) এর পছন্দের বিরুদ্ধে ওয়ার্মিয়ার বিশপ নির্বাচিত হন যেখানে রাজা তার নিজের পুত্রকে বসাতে চেয়েছিলেন। তিন বছর পর কাসিমির(৬) এর মৃত্যু পুর্ব পর্যন্ত ওয়াটজেনোরদের ঝগড়া হয়। এরপর ওয়াটজেনোরদে জুনিয়র তিন সফল পোলিশ শাসকের সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারা হলেন জন(প্রথম) আলবার্ট, আলেকজান্ডার জাগলিন এবং সিগমুয়েড(প্রথম)। তিনি প্রত্যেক শাসকের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন এবং প্রধান উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন। তার প্রভাবের ফলে ওয়ার্মিয়া এবং পোল্যান্ডের মধ্যকার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের ওয়ার্মিয়ার ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি কোপার্নিকাসের শিক্ষাজীবনে এবং কর্মজীবনে অনেক সাহায্য করেন
কোপার্নিকাস ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন। তিনি পোলিশ, গ্রীক এবং ইটালিয়ান ভাষাতেও কথা বলতে পারতেন। তবে তিনি কাজ করেছেন বেশিরভাগ ল্যাটিন ভাষায়। কারণ, তখনকারদিনে ইউরোপের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহৃত হত। এছাড়াও ল্যাটিন, রোমান ক্যাথলিক চার্চে ও পোল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় আদালতের প্রধান ভাষা ছিল। আর এভাবেই ল্যাটিন ভাষায় চার্চ এবং পোলিশ শাসকদের সাথে নিকোলাসের যোগাযোগ ছিল। কোপার্নিকাসের লিখা কিছু তথ্য প্রমাণ জার্মান ভাষায়ও আছে। এই বিষয়টি জার্মানির দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মার্টিন ক্যারিয়ার উল্লেখ করেন। কারণ হলো কোপার্নিকাসের স্থানীয় ভাষাও ছিল জার্মান।
কোপার্নিকাস খুব ভালো জার্মান বলতে পারতেন তার অন্যতম কারণ হলো তিনি জার্মান ভাষাভাষী একতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৯৬ সালে তিনি যখন বলগনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন তখন তিনি জার্মান ভাষার একটি দলে(সংগঠনে) যোগদান করেন। ১৪৯৭ সালের সংবিধান অনুযায়ী এই সংগঠনটির সদস্য তারাই হতে পারতেন যাদের মাতৃভাষা ছিল জার্মান। যাই হোক, ফরাসি দর্শবিদ আলেকজান্দ্রে কোয়রের মতে, কোপার্নিকাস নাটিও সংগঠনে জার্মান ভাষা জানতো বলে যোগদান করেনি বরং সে নিজেকে জার্মান ভাবত তাই যোগ দিয়েছিলো। তখন প্রুশিয়া এবং সিলেসিয়া থেকে নিয়মিত ছাত্র শ্রেনীভুক্ত করা হতো যা জার্মান ভাষাভাষী শিক্ষার্থীতের জন্য জাতিগতভাবে গর্বের ছিলো।
নাম
কোপার্নিক হল বংশীয় উপাধি। এই কপার্নিগ নাম ১৩৫০ সালে কারাকাও থেকে সংগ্রহ করা হয়। ১৮৪৫ সালের পূর্বে সিলেসিয়া এর ডিচি অব নাইসা গ্রামের লোকদেরকে কোপের্নিগ বলা হতো। ১৪৯৩ সালে দি নুরেমবার্গ ক্রোনিকল প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয় গ্রামের মানুষের স্থানীত মাতৃভাষা ছিল পোলিশ। ১৩৮৬ সালে নিকোলাস কোপার্নিকাসের প্রপিতামহ কারাকাওতে নাগরিকত্ব লাভ করে বসবাস করতে শুরু করে। বর্তমান কপার্নিকি নামটি মূলত এসেছে জার্মান কপার এবং পোলিশ অর্থ ডিল(কপার) হতে। নিক এবং বহুবচন নিকি যা পোলিশ শব্দে বিশেষ্য হিসেবে কাজ করে। সেই সময়ের মধ্যে সাধারণ হিসাবে, উভয় শীর্ষস্থানীয় এবং উপাধির বানানে ব্যাপকভাবে পরিবরতন হয়েছে। কোপার্নিকাস এসব ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন ছিলেন।
তার শৈশবের সময় ১৪৮০ সালে তোরনে একবার তার বাবার নাম নিকোলাস কোপেরনিইগক সংগ্রহ করা হয়। কারাকাওতে তিনি ল্যাটন ভাষায় নিজের নাম নিকোলাস, নিকোলাসে পুত্র নিবন্ধন করেন। ১৪৯৬ সালে তিনি নাটিও জার্মান সংগঠনে তার নাম ডমিনাস নিকোলাস কোপার্নিক নিবন্ধন করেন। পাদুয়াতে তিনি নিজের নাম নিকোলাস কোপার্নিক স্বাক্ষর করলেও পরে তা কোপার্নিকাসে পরিবর্তন করেন। ল্যাটিন ভাষায় Coppericus লিখার সময় তিনি প্রথমে দুইটি “P” ব্যবহার করতেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি একটি “P” ব্যবহার করেন। তার গ্রন্থ “দি রিভলিউশনিবাস” এর শিরোনামে “নিকোলাই কোপার্নিকি” উল্লেখ করা হয়।