টাইটানিক ১৪ এপ্রিল সমুদ্র বরফের ছয়টি সতর্কবার্তা পেয়েছি কিন্তু তার চালক যখন হিমশৈল দেখে তখন এটি সর্বোচ্চ গতির কাছাকাছি ভ্রমণ করছিলো। দ্রুত পর্যাপ্ত পরিমাণ মোড় নিতে অক্ষম থাকায়, মারাত্মক আঘাতে জাহাজটি স্টারবোডের (ডান) দিকে ষোলটি বগির মধ্যে পাঁচটি সমুদ্রে ছাড়ে। টাইটানিক পরিকল্পিত হয়েছে শুধুমাত্র চারটি অগ্রবর্তী বগি ভাসানোর জন্যে কিন্তু এর বেশি নয়।
আরএমএস টাইটানিকের নিমজ্জনের সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে প্রথম সমুদ্রযাত্রার চার দিনের প্রথম দিন ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রাত থেকে ১৫ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ঘটনা ঘটেছে। সে সময়ের বৃহত্তম যাত্রীবাহী পরিষেবা, টাইটানিক জাহাজে আনুমানিক ২,২২৪ মানুষ ছিল যখন এটি ২৩:৪০ (জাহাজের সময়)।[ক] ১৫ এপ্রিল, সোমবার ০২:২০ (০৫:১৮ জিএমটি) পর্যন্ত দুই ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট সময় ধরে এই ডুবে যাওয়ার ঘটনার ফলে ১,৫০০ বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা ইতিহাসে শান্তিকালীন সময়ে প্রানঘাতী সামুদ্রিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে।
“নিরাপদ ক্যাপ্টেন”, “মিলিয়নিয়ার ক্যাপ্টেন” ইত্যাদি বিভিন্ন নামে খ্যাত এবং ১৫ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তখনকার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংল্যান্ডের রাজকীয় কমান্ডার এডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে টাইটানিক ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
১৪ই এপ্রিল ১৯১২ তারিখ রাত্রে নিস্তব্দ সমুদ্রের তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রীরও কাছাকাছি নেমে যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলেও চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না।সামনে আইসবার্গ(বিশাল ভাসমান বরফখন্ড) আছে এ সংকেত পেয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজের গতি সামান্য দক্ষিণ দিকে ফিরিয়ে দেন[a]। সেদিনই দুপুর ১:৪৫ এর দিকে Amerika নামক একটি জাহাজ রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ করে টাইটানিকের সামনে বড় একটি আইসবার্গ আছে বলে সর্তক করে দেয়[১১] কিন্তু টাইটানিকের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা জ্যাক পিলিপস্ এবং হ্যারল্ড ব্রীজ এ তথ্যটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে টাইটানিকের মূল্য নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে এ তথ্য প্রেরণ করেনি[১২]। একই দিনেই পরবর্তিতে Mesaba নামক আরেকটি জাহাজ টাইটানিকের পথে অবস্থিত ঐ বিশাল আইসবার্গটির ব্যাপারে আবারো সতর্ক করে দেয় কিন্তু দূভাগ্য তথ্যটি এবারো রেডিও অপারেটরদের কারণে টাইটানিকের মূল যোগাযোগ কেন্দ্রে পৌছায়নি।
সেদিনই রাত ১১:৪০ এর সময় টাইটানিকের পথ পর্যবেক্ষণ কারীরা সরাসরি টাইটানিকের সামনে সেই আইসবার্গটি দেখতে পায় কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুর্ডক আকস্মিকভাবে বামে মোড় নেওয়ার অর্ডার দেন এবং জাহাজটিকে সম্পূর্ণ উল্টাদিকে চালনা করতে বা বন্ধ করে দিতে বলেন[১৩][১৪]। টাইটানিককে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। এর ডানদিক আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘর্ষণ খেয়ে চলতে থাকে। ফলে টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়।
জাহাজটি সর্বোচ্চ চারটি পানিপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ভেসে থাকতে পারতো কিন্তু পানিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ৫ টি কম্পার্টমেন্ট । এ পানিপূর্ণ কম্পার্টমেন্টগুলো ওজনের কারণেই জাহাজটির সামনের দিক আস্তে আস্তে পানিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। এ আকস্মিকতায় ক্যাপ্টেন স্মিথ মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে আসেন এবং জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেন। ১৫ তারিখ মধ্যরাত্রির দিকে লাইফবোটগুলো নামানো শুরু হয়। টাইটানিক বিভিন্ন দিকে জরুরী বিপদ সংকেত পাঠিয়েছিল। যেসকল সিপগুলো সাড়া দিয়েছিল তার অন্যতম হল মাউন্ট ট্যাম্পল, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং টাইটানিকের সহোদর অলেম্পিক। সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত Carpathia জাহাজটি টাইটানিকের প্রায় ৯৩ কি.মি. দূরে ছিল। সেখান থেকে টাইটানিক পর্যন্ত পৌছাতে জাহাজটির সময় লাগতো প্রায় ৪ ঘণ্টা। কেইপ রেইসের,নিউফাউন্ডল্যান্ডের ওয়ার্লেস স্টেশনটিই একমাত্র ভূমিভিত্তিক ওয়ার্লেস স্টেশন যেটি টাইটানিকের বিপদ সংকেত পেয়েছিল।[১৫]
টাইটানিকের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হতে দূরবর্তী একটি জাহজের আলো দেখা যাচ্ছিল যার পরিচয় এখনো রহস্যে ঘেরা। কেউ কেউ বলে সেটি ছিল Californian আবার কেউ কেউ বলে সেটি ছিল Sampson[১৬] । টাইটানিক থেকে ওয়ারলেস মাধ্যমে যোগাযোগে কোন সাড়া না পেয়ে পরবর্তিতে মর্স ল্যাম্প এবং শেষে জরুরী রকেট ছোড়ার মাধ্যমেও জাহাজটির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় কিন্তু জাহাজটি একবারও সাড়া দেয়নি।
টাইটানিক দুর্ঘটনার মাত্র ৪০ মিনিট আগে Californian সিপের রেডিও অপারেটর টাইটানিকের সাথে যোগাযোগ করে আইসবার্গটি সম্পর্কে বলতে চেয়েছিল কিন্তু টাইটানিকের রেডিও অপারেটর ক্লান্ত জ্যাক পিলিপস্ রাগান্বিত ভাবে বলে ”আমি কেইপ রেসের সাথে কাজে ব্যস্থ এবং লাইন কেটে দেয়।” ফলে Californian সিপের রেডিও অপারেটর তার ওয়ার্লেস বন্ধ করে ঘুমাতে চলে যায়। ডুবার পূর্ব-মূহুর্ত্য পর্যন্ত টাইটানিকের রেডিও অপারেটররা মর্স কোডের মাধ্যমে CQD মেসেজ এবং শেষমূহুর্ত্যের দিকে কারো কারো মতে টাইটানিক থেকে মোর্স কোডের মাধ্যমে SOS ম্যাসেজও প্রেরণ করা হয়।[১৫] (ব্রিটিশ নাবিকরা CQD বেশি পছন্দ করতো)
রাত ০২:০৫ দিকে জাহাজের সম্পূর্ণ মাথাই প্রায় পানির কাছাকাছি চলে আসে। ০২:১০ এর দিকে প্রপেলারকে দৃশ্যমান করে দিয়ে জাহাজের পেছনের দিক উপরের দিকে উপরে উঠতে থাকে। ০২:১৭ এর দিকে জাহাজের সামনের দিকের ডেক পর্যন্ত পানি উঠে যায়। এ মূহুর্তেই শেষ দুটি লাইফবোট টাইটানিক ছেড়ে যায় বলে এত বিস্তারিত ভাবে জানা গেছে। জাহাজের পেছনের দিক ধীর ধীর আরো উপরের দিকে উঠতে থাকে এসময় জাহাজের বিদ্যুতিক সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায় এবং চারদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। এর কিছুক্ষন পরেই ভারের কারণে টাইটানিকের পেছনের অংশ সামনের অংশ থেকে ভেঙ্গে যায় এবং জাহাজের সম্মূখভাগ সম্পূর্ণরুপে পানির নিচে চলে যায়। ফলে জাহাজের পেছনের অংশ ধীরে ধীরে খাড়া হতে হতে একেবারে লম্বভাবে খাড়া হয়ে যায়। বায়ুজনিত কারণে এ অংশটি কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর রাত ০২:২০ এর দিকে ধীরে ধীরে জাহাজের এ বাকী অংশটিও সমূদ্রের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়।
মাএ দুটি লাইফবোট আবার উদ্ধার কাজে ফিরে এসেছিল। এর মধ্যে লাইফবোট-৪ পাঁচজন যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল যার মধ্যে দুজন পরবর্তিতে মারা যায়। একঘণ্টার মধ্যে লাইফবোট-১৪ ফিরে আসে এবং আরো ৪ জন ব্যক্তিকে উদ্ধার করে যাদের একজন পরে মারা যায়। সকাল ০৪:১০ এর দিকে Carpathia জাহাজটি এসে পৌছায় এবং বেঁচে থাকাদের উদ্ধার করা শুরু করে