৭ই মার্চকে আমরা বলি ঐতিহাসিক দিন। ৭ই মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বলি ঐতিহাসিক ভাষণ। ইউনেসকো বিশ্বের ঐতিহ্যমণ্ডিত শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর একটি হিসেবে এটাকে মর্যাদা দিয়েছে। সন্দেহ নেই ৭ই মার্চের এই ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক সাহিত্যে একটি বিরল ভাষণ। আমাদের কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, এই ভাষণ একটি মহাকাব্য। আর এই ভাষণটি যিনি দিয়েছেন, তিনি একজন মহাকবি। আমার মতে, এই ভাষণ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মহাকাব্য। কিন্তু ১৬ কোটি বাঙালির হৃদয়ে মুদ্রিত। এই ভাষণ যিনি দিয়েছেন, লন্ডনের সানডে টাইমস তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘A poet of politics’ (একজন রাজনীতির কবি)। কথাটা তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনীতি একটি জাগতিক ও লৌকিক ব্যাপার। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে অলৌকিকত্ব দান করেছেন।
ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে জিত বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি একটি বুদ্ধিজীবী সমাবেশে বলেছিলেন, ‘তোমাদের ৭ই মার্চের দিনটি ও ভাষণটি শুধু ঐতিহাসিক দিন এবং ঐতিহাসিক ভাষণ নয়, এটি একটি ধ্রুপদী দিন ও ধ্রুপদী ভাষণ, যেদিন এ ভাষণের গর্ভ থেকে একটি স্বাধীন জাতির জন্ম হয়েছে। ফ্রান্সে দূর-অতীতে বাস্তিল দুর্গ ভাঙার দিনটিকে বলা হয় ধ্রুপদী দিন। এই দিনটির গর্ভেই একটি বিপ্লবের জন্ম এবং যে বিপ্লব থেকে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের উদ্ভব।’
বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকরা বাস্তিল দুর্গ তৈরি করেনি। গোটা দেশটাকেই বাস্তিল দুর্গে পরিণত করেছিল। বাস্তিল দুর্গের যুগে ফ্রান্সে রাজাদের শোষণ-পীড়নে একসময় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল। রানি রাজশকটে প্যারিসের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি অনাহারি প্রজাদের হাহাকার শুনে সহচরীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ওরা কাঁদে কেন? সহচরীরা বলেছিল, ওরা ক্ষুধার্ত। দেশে রুটির অভাব। দুর্ভিক্ষ চলছে। তাই ওরা হাহাকার করছে। রানি সহচরীদের কথা শুনে হেসে বললেন, দেশে রুটি নেই, তা ওরা কেক খায় না কেন?
গত শতকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও ঘটেছিল একটি ঘটনা। খাদ্যাভাব ছিল বাৎসরিক। প্রতিবছর ধান-চালের ঘাটতি ছিল ২৭ লাখ টন। বাইরে থেকে চাল আমদানি করা হতো বটে, কিন্তু ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করা হতো না। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা (দুর্ভিক্ষ) লেগেই ছিল। এই খাদ্যাভাবপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানে একবার পাকিস্তানের তৎকালীন ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান এলেন। তিনি সর্বত্র দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখে ফ্রান্সের রানির মতো বললেন, ‘বাঙালিরা এত চাল খায় কেন? তারা গম-ভুট্টা খেতে পারে না?’
বাঙালিরা চৌদ্দপুরুষ ধরে ভাত খেতে অভ্যস্ত। তারা কী করে খাবে ভুট্টা? তার ওপর ভুট্টার সরবরাহও কম। পাবনায় ক্ষুধার্ত মানুষ বিদ্রোহী হলো। পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর গুলি চালাল। বহু লোক আহত-নিহত হলো। এই আন্দোলনের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। এই আন্দোলন পাবনার ভুট্টা আন্দোলন নামে খ্যাত।
পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করেনি। তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সব কেড়ে নিয়ে একটি দাস জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছে। বলেছে, ‘তুম বাংলা বোলতা হায় কিউ, উর্দু বোল। বাংলা হিন্দুয়ানি জবান হায়।’ তারা ভাত, শাড়ি, কপালে টিপ পরা সব কিছুরই ওপর হিন্দুয়ানির ছাপ মেরেছিল। বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালির হাজার বছরের পরিচয় মুছে ফেলে একমাত্র পরিচয় রাখা হয়েছিল পাকিস্তানি। কিন্তু পাকিস্তানে বাঙালিকে সমান নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়নি। তারা ছিল চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার।
আমরা অনেকেই আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের তুলনা করি। তুলনা অবশ্যই করা চলে। লিঙ্কনের ভাষণ ছিল একটি গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার দিকনির্দেশ। আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে ভাষণটিতে বিশ্বজনীনতার আবেদন রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণও একটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক। এই ভাষণও আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির পথনির্দেশ দ্বারা বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি ভাষণের মধ্যে অমিল এটুকু যে একটির পটভূমি গৃহযুদ্ধ। অন্যটির মুক্তিযুদ্ধ। একটি ভাষণ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। অন্য ভাষণটি একটি স্বাধীন জাতি ও তার জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।