১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল ৫৪.৭%। কিন্তু রপ্তানি আয়ে এগিয়ে থাকলেও আমদানি ব্যয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩১.১%। পূর্ব পাকিস্তানে সহজলভ্য কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে অধিকাংশ শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়। সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহ করে বেশি দাম দিয়ে পশ্চিমে উৎপাদিত পণ্য কিনতে হত পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদেরকে। এছাড়া যাও বা সামান্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছিল পূর্বে, সেসবের মালিকানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পাকিস্তানের শিল্প মূলত ৪৩ টি পরিবারের হাতে ছিল। যার মধ্যে ২২ টি পরিবার পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক হলেও কেবল একটি পরিবার ছিল বাঙালি। ১৯৬২ সালে ৭৩% ব্যক্তিমালিকানাধীন অর্থনীতি এই ৪৩ পরিবারের হাতে ছিল। ৭ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল মোট ব্যাংক জামানতের ৬০% এর মালিক। মোট শিল্প সম্পদের ১৮% বাঙালি ও ৪৭% পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানায় এবং ৩৫% রাষ্ট্রায়ত্ত ছিল।
ব্যবসা বাণিজ্য শিল্পক্ষেত্রের বাইরে চাকরিক্ষেত্রেও বঞ্চনা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি। অধিকাংশ সরকারি দপ্তরের সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাসমূহ সেখানেই অনুষ্ঠিত হত। হাজার-দেড় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের পক্ষে চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া প্রায়ই সম্ভব হত না।
পাকিস্তানের সামরিক বিভাগে নিয়োগে কোটা প্রথা ছিল। মোট পদের ৬০% পাঞ্জাবি, ৩৫% পাঠান এবং বাকি ৫% পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের অধিবাসী ও পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য বরাদ্দ ছিল। বাঙালিদের দাবির মুখে সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তা ছিল নগণ্য। ১৯৫৭ সালে মেজরের উপরের পদে ৮৯৭ জন কর্মতার মাঝে বাঙালি ছিলেন ১৩ জন। কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার, মেজর জেনারেল ও জেনারেল পদে কোন বাঙালি ছিলেন না।
বেসামরিক প্রশাসনেও পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বৈষম্য ছিল। ১৯৫৫ সালে ১৯ জন সচিবের মধ্যে একজন বাঙালিও ছিলেন না। ৪১ জন যুগ্মসচিবের মাঝে ৩ জন ছিলেন বাঙালি। ১৩৩ জন উপসচিবের মধ্যে ১০ জন এবং ৫৪৮ জন বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন বাঙালি।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব বৈষম্যের প্রতিফলন দেখা যায় পূর্ব ও পশ্চিমের জীবনযাত্রার মানে। প্রধান দুটি খাদ্যশস্য, ধান ও গমের মূল্যে দুই অংশে ছিল বিশাল ফারাক। পশ্চিম পাকিস্তানে যখন চালের দাম মণ প্রতি ১৮ রুপি, পূর্বে তখন প্রায় তিনগুণ, ৫০ রুপি। পশ্চিম পাকিস্তানে গমের মণ যখন ১০ রুপি, পূর্ব পাকিস্তানে ৩৫ রুপি। একই দেশের দুই অংশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে এত পার্থক্য স্বাভাবিক ছিল না। মাথাপিছু আয় কম হলেও পূর্ব পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল বেশি। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রার মান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে নিচু।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্বর্ণ এবং টাকাপয়সা নিতে কোন বাধা ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্বে আনতে বাধা ছিল। এসব কারণে একই দেশের দুই প্রান্তে স্বর্ণের দামে বিরাট পার্থক্য ছিল।