গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে যিনি আদি পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন তাঁর নাম পিথাগোরাস। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান তুরস্কের পশ্চিমে ইজিয়ান সাগরের সামস দ্বীপে পিথাগোরাসের জন্ম। এই সামস ছিল গ্রীসের ক্রেতনা দ্বীপের অন্তর্ভক্ত। ছেলেবেলা থেকেই বিদ্যা অনুরাগের প্রতি প্রবল আকর্ষন ছিল পিথাগোরাসের। তিনি বিশ্বাস করতেন কোন একজন গুরুর কাছে জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। জ্ঞানের ভান্ডার ছড়িয়ে আছে পৃথিবী ব্যাপী। তাই সামস শহরে তাঁর শিক্ষা শেষ করে বের হলেন দেশ ভ্রমনে। সেই সময় গ্রীস দেশের বাণিজ্যতরী গুলি বিভিন্ন দেশে বানিজ্য করতে যেত। এমনি একটি জাহাজে করে তিনি রওনা হলেন মিশরে । প্রাচীন গ্রীসের মত প্রাচীন মিশরও ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভুমি। এখানে প্রধানত গণিত ও জ্যোতি বিজ্ঞানের শিক্ষা লাভ করেন। মিশরে অবস্থানের সময় পিরামিড দর্শন করে বিষ্ময়ে অভিভুত হয়ে যান। বিশাল পিরামিড নির্মানের সময় যে গণিতিক নিয়ম অনুসারে পাথরগুলিকে সাজান হয়েছিল তা থেকেই সম্ভবত তাঁর মনে প্রথম জ্যামিতি সমন্ধে চিন্তা-ভাবনা জেগে উঠে। যদিও জ্যামিতির জনক ইউক্লিড, (আনুমানিক ৩২০-২৭৫ খ্রিষ্টপূর্ব)। তিনিই প্রথম জ্যামিতির জন্য সুসংহতভাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। কিন্তু তাঁর অন্তত দুশো বছর আগে পিথাগোরাস জ্যামিতি বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এরই পরিণতি তাঁর বিখ্যাত উপপাদ্য সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গই ত্রিভুজের অপর দুই বাহুর উপর বর্গের যোগফলের সমান। এই বিষয়ে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। পিথাগোরাস দেশভ্রমন করতে ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হন। প্রাচীন মিশরের মত ভারতবর্ষও ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমি। পিথাগোরাসের আবির্ভাবের অন্তত একশ বছর ভারতীয় পন্ডিত বৌধয়ন জ্যামিতি সমন্ধে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। সম্ভবত তাঁর কোন সূত্র থেকে পিথাগোরাস এই উপপাদ্যটি রচনা করেন। কোন সূত্র থেকে তিনি এই রচনাটি করেছিলেন তা জানা গেলেও এটি যে তার মৌলিক রচনা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে পিথাগোরাসই জ্যামিতি চর্চা শুরু করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর বিরাট কিছু দান থাকলেও তিনি যে পথের সূচনা করেছিলেন সেই পথ ধরেই পরবর্তী কালে অন্যরা জ্যামিতিকে প্রসারিত করেছেন। পিথাগোরাস বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করে ফিরে আসেন সামোসে। সেই সময়ে রাজা ছিলেন পলিক্রেটিস। রাজা যেমন ছিলেন স্বেচ্ছাচারী তেমনি অত্যাচারী। পিথাগোরাস ক্রোতনায় গিয়ে বসবাস আরম্ভ করলেন। ইতোমধ্যে পিথাগোরাসের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্ররা শিক্ষা লাভের জন্য ক্রোতনায় ভিড় জমাতে থাকে। মূলত ধর্ম, দর্শন, এবং বিজ্ঞান এই তিনটি বিষয়ে তিনি শিক্ষা দিতেন। তাঁর শিষ্যদের বলা হত পিথাগোরীয়ান।
"পিথাগোরাসের উপপাদ্য"
গণিতবিদ্যায় পিথাগোরাসের উপপাদ্য বা পিথাগোরিয়ান থিউরেম হল ইউক্লিডীয় জ্যামিতির অন্তর্ভুক্ত সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহু সম্পর্কিত একটি সম্পর্ক। এই উপপাদ্যটি গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাসএর নামানুসারে করা হয়েছে, যাকে ঐতিহ্যগতভাবে এই উপপাদ্যদের আবিষ্কারক ও প্রমাণকারী হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে উপপাদ্যটির ধারণা তার সময়ের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। চীনে এই উপপাদ্যটি “গোউযু থিউরেম” (勾股定理) হিসেবে প্রচলিত যা ৩, ৪ ও পাঁচ বাহু বিশিষ্ট ত্রিভুজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই উপপাদ্যমতে, কোন একটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল ঐ ত্রিভুজের অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান। যদি আমরা c কে অতিভুজ এবং a ও b কে অপর দুই বাহুর দৈর্ঘ্য ধরি, তাহলে সমীকরণের সাহায্যে উপপাদ্যটি হবে,
a^2 + b^2 = c^2\,
বা, c এর মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে:
c = \sqrt{a^2 + b^2}. \,
এই সূত্রে সমবাহু ত্রিভুজের একটি বৈশিষ্ট্য সাধারণ সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় যার মাধ্যমে কোন ত্রিভুজের দুটি বাহুর দৈর্ঘ্য জানা থাকলে তৃতীয় বাহুর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যায়। এই সূত্রের একটি সাধারণকৃত রূপ হল ল অফ কজিনস যার সাহায্যে যে কোন ত্রিভুজের তৃতীয় বাহুর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যায় যখন বাকী দুটি বাহুর দৈর্ঘ্য এবং তাদের মধ্যকার কোণের মান দেয়া থাকে। যদি বাহু দুটির মধ্যকার কোণটি সমকোণ হয় তবে পিথাগোরাস উপপাদ্যের সাহায্যে তা নির্ণয় সম্ভব।