লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ: অর্থ; মহান আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তা ছাড়া আর কোন আশ্রয় ও সাহায্য নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, أَكْثِرْ مِنْ قَوْلِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ فَإِنَّهَا كَنْزٌ مِنْ كُنُوزِ الْجَنَّةِ তুমি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বেশি বেশি বলো। কেননা তা জান্নাতের রত্নভাণ্ডারের অন্তর্ভুক্ত।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘হে মানুষ! তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে বেশি বেশি স্মরণ কর, সকাল-সন্ধ্যায় তোমরা তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর।’ (সূরা: আল আহজাব, আয়াত: ৪১-৪২)।
মাছের জন্য যেমন পানি দরকার অনুরূপ অন্তরের জন্য জিকির আবশ্যক। জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা লাভ করা যায়। তার নিকটবর্তী হওয়া ও সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। জিকিরের মাধ্যমে অন্তরের দুঃখ-বেদনা ও দুশ্চিন্তা দূর হয়। অন্তর জীবিত থাকে, তাতে শক্তি ও পরিচ্ছন্নতা সৃষ্টি হয়।
অন্তরের মধ্যে যে শূন্যতা ও অভাব থাকে আল্লাহর জিকির ছাড়া তা দূর হয় না। একইভাবে অন্তরের মধ্যে যে কঠোরতা আছে আল্লাহর জিকির ছাড়া তা নম্র হবে না। জিকির হচ্ছে অন্তরের আরোগ্য ও পথ্য এবং শক্তি। জিকিরের আনন্দ-স্বাদের তুলনায় কোনো আনন্দ নেই, কোনো স্বাদ নেই। অন্তরের রোগ হচ্ছে জিকির থেকে উদাসীনতা।
আসুন আপনার, আমার তথা সবার প্রতিদিনের কথা ও কাজ সাজিয়ে তুলি ফজিলতপূর্ণ দশটি সহজ জিকির দ্বারা।
(১) বিসমিল্লাহ: বিসমিল্লাহ শব্দের অর্থ, আল্লাহর নামে শুরু করছি। কাজের শুরুতে (بسم الله) বিসমিল্লাহ বলার অভ্যাস করুন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, كُلُّ كَلَامٍ أَوْ أَمْرٍ ذِي بَالٍ لَا يُفْتَحُ بِذِكْرِ اللهِ فَهُوَ أَبْتَرُ — أَوْ قَالَ : أَقْطَعُ ‘প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি আল্লাহকে স্মরণ না করে শুরু করা হয়, তাহলে তা লেজ কাটা (বরকতহীন) হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমদ ১৪/৩২৯)।
(২) সুবহানাল্লাহ: সুবহানাল্লাহ (سُبْحَانَ اللّٰهِ) শব্দের অর্থ আল্লাহ পবিত্র ও সুমহান।
আশ্চর্যজনক ভালো কোনো কাজ হতে দেখলে কিংবা বিস্ময়কর ভালো কোনো কথা শুনলে এটি বলার অভ্যাস করুন।যেমন, সুবহানাল্লাহ! আগুনে পুরো ঘর পুরে গেলেও কোরআন শরিফ অক্ষত আছে!
(৩) আল হামদুলিল্লাহ: আল হামদুলিল্লাহ (الْحَمْدُ لِلّٰهِ) শব্দের অর্থ, সব প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য।
যেকোনো সুখবর বা ভালো অবস্থা সম্পর্কিত সংবাদের বিপরীতে সাধারণত এটি বলার অভ্যাস করুন। । যেমন, ভাই আপনি কেমন আছেন? জবাবে বলুন, আল হামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, أَفْضَلُ الْكَلَامِ أَرْبَعٌ: سُبْحَانَ اللّٰهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ ‘সর্বোত্তম (মর্যাদাপূর্ণ) বাক্য হলো চারটি– (১) সুবহানাল্লাহ (سُبْحَانَ اللّٰهِ), (২) আল হামদুলিল্লাহ (الْحَمْدُ لِلّٰهِ), (৩) লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ (لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ), (৪) আল্লাহু আকবার (اللّٰهُ أَكْبَرُ)।’ (মিশকাত ২২৯৪)।
(৪) মাশা আল্লাহ: মাশা আল্লাহ (ما شاء الله) শব্দের অর্থ, আল্লাহ যেমন চেয়েছেন।
এটি আল হামদুলিল্লাহ ও সুবহানাল্লাহ শব্দের মতোই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ যেকোনো সুন্দর এবং ভালো ব্যাপারে এটি বলুন। যেমন, মাশা আল্লাহ তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, من رأى شيئاً فأعجبه فقال : ما شاء الله لا قوة إلا بالله : لم تصبه العين ‘যে ব্যক্তি কোনো বিস্ময়কর বস্তু দেখার পর মাশা আল্লাহ লা-কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলবে, তবে তাকে কুদৃষ্টি স্পর্শ করবে না।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ ৫/২১)।
(৫) নাউযুবিল্লাহ: নাউযুবিল্লাহ (نعوذ بالله) শব্দের অর্থ, আমরা মহান আল্লাহর কাছে এ থেকে আশ্রয় চাই। যেকোনো মন্দ ও গুনাহের কাজ দেখলে তার থেকে নিজেকে আত্মরক্ষার্থে এটি বলুন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ جَهْدِ الْبَلاَءِ، وَدَرَكِ الشَّقَاءِ، وَسُوءِ الْقَضَاءِ، وَشَمَاتَةِ الأَعْدَاءِ ‘তোমরা ভয়াবহ বিপদ, হতভাগ্যের অতল গহবর, মন্দ তাকদির এবং শত্রুর আনন্দ প্রকাশ থেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রর্থনা কর।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৬৩)।
(৬) ইনশা আল্লাহ: ইনশা আল্লাহ (ان شاء الله) শব্দের অর্থ, যদি আল্লাহ চান। কোনো ভালো কাজ ভবিষ্যতে করতে চাইলে এটি বলুন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَلِكَ غَدًاإِلَّا أَن يَشَاء اللَّه ‘আপনি কোনো কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামীকাল করব; ‘যদি আল্লাহ চান‘ বলা ব্যতিরেকে। (সূরা: কাহাফ, আয়াত: ২৩)।
(৭) আসতাগফিরুল্লাহ: আসতাগফিরুল্লাহ শব্দের অর্থ আমি মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। অনাকাঙ্খিত কোন অন্যায় বা গুনাহ হয়ে গেলে আমরা এটি বলবো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, وَاللّٰهِ إِنِّىْ لِأَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِى الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِيْنَ مَرَّةً ‘আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন সত্তরবারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তাওবাহ করি।’ (সহিহ বুখারি: ৬৩০৭)।
(৮) জাযাকাল্লাহু খায়রা: এর অর্থ, আল্লাহ আপনাকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন। কেউ আপনার কোনো উপকার করলে তাকে থ্যাংক ইউ না বলে বলুন, জাযাকাল্লাহু খায়রা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ، فَقَالَ لِفاعِلهِ: جَزَاكَ اللهُ خَيراً، فَقَدْ أَبْلَغَ فِي الثَّنَاءِ ‘যে ব্যক্তির জন্য কোনো উপকার করা হলো এবং সে উপকারকারীকে ‘জাযাকাল্লাহু খায়রা’ বলে দোয়া দিল, সে নিঃসন্দেহে (উপকারীর) পূর্ণাঙ্গরূপে প্রশংসা করল।’ (তিরমিযী ২০৩৫)।
(৯) ইন্নালিল্লাহ বা ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জিউন: إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ অর্থ, নিশ্চয়ই আমরা মহান আল্লাহর জন্য এবং আমরা তার দিকেই ফিরে যাবো। যেকোনো দুঃসংবাদ বা বিপদের সময় আমরা এটি বলবো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ وَلَا مُسْلِمَةٍ يُصَابُ بِمُصِيْبَةٍ فَيَذْكُرُهَا وَإِنْ طَالَ عَهْدُهَا فَيُحْدِثُ لِذلِكَ اسْتِرْجَاعًا إِلَّا جَدَّدَ اللّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالى لَه عِنْدَ ذلِكَ فَأَعْطَاهُ مِثْلَ أَجْرِهَا يَوْمَ أُصِيْبَ بِهَا ‘কোনো মুসলিম নর-নারী কোনো বিপদাপদে পড়ার যত দীর্ঘ সময় পর মনে জেগে ওঠে আর সে নতুনভাবে ‘ইন্নালিল্লাহ বা ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জিউন’ পড়ে তাহলে আল্লাহ তাকে নতুনভাবে সে সওয়াবই দেবেন যে সওয়াব সে বিপদে পতিত হওয়ার প্রথম দিনই পেয়েছে।’ (মুসনাদ আহমাদ: ১৭৩৪)।
(১০) লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ: অর্থ, মহান আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তা ছাড়া আর কোনো আশ্রয় ও সাহায্য নেই। শয়তানের কোনো ওয়াসওয়াসা বা দূরভিসন্ধিমূলক কোনো প্রতারণা থেকে বাঁচার জন্য বেশিহারে আমাদের এটি পড়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, أَكْثِرْ مِنْ قَوْلِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ فَإِنَّهَا كَنْزٌ مِنْ كُنُوزِ الْجَنَّةِ তুমি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বেশি বেশি বলো। কেননা তা জান্নাতের রত্নভাণ্ডারের অন্তর্ভুক্ত।
মাকহুল (রহ.) বলেন, যে লোক ‘লা হাওলা ওয়াল কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ ওয়ালা মানজায়া মিনাল্লাহি ইল্লা ইলাইহি’ পাঠ করে, আল্লাহ তায়ালা তার হতে সত্তর প্রকারের অনিষ্ট অপসারণ করেন এবং এগুলোর মাঝে সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিপদ হলো দরিদ্রতা। (তিরমিজি ৩৬০১)।
অধিকহারে আল্লাহর জিকিরকারী সর্বশ্রেষ্ঠ আমলকারীদের অন্যতম। জিকিরের মাধ্যমে কঠিন বিষয় সহজ হয়, দুর্বোধ্য জিনিস সাবলীল হয়, কষ্ট হালকা হয়, রিজিকের পথ উন্মুক্ত হয়, শরীর শক্তিশালী হয়। জিকিরের মাধ্যমে শয়তান দূরীভূত হয়, তার মূলোত্পাটন করে, তাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার জিকির করার তাওফিক দান করুন। আমিন।