স্বাভাবিক ভাবে একটি পুরুষের ১৮.৫ আর নারীদের ১৬.৫। এর বেশি হিমোগ্লোবিন হয়ে গেলে তা ‘পলিসাইথিমিয়া’ নামের রোগের প্রধান লক্ষণ৷ বিশ্লেষকদের মতে হিমোগ্লোবিন বেড়ে গেলে রক্ত ঘন হয়৷ ছোট ছোট রক্তের ডেলা তৈরি হওয়ার সুযোগ বাড়ে৷ ভাল করে চিকিৎসা না হলে সেই সব রক্তের ডেলা হার্ট, ফুসফুস, মস্তিষ্ক বা পায়ের রক্তনালিতে জমে হার্ট অ্যাটাক, পালমোনারি এমবলিজম, স্ট্রোক বা পায়ে ডিপ ভেন থ্রম্বোসিসের মতো জটিল অসুখের প্রকোপে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
পলিসাইথিমিয়া দু’রকম৷ প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি৷ প্রাইমারি রোগ হয় অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারোতে রক্ত তৈরি হওয়ার পদ্ধতিতে কিছু গোলমাল হলে৷ তবে এটি খুবই বিরল। লাখখানেক মানুষের মধ্যে একজনের এই সমস্যা থাকে৷ কিছু পরিবারে একাধিক জনের এই সমস্যা থাকলেও রোগটি বংশগত নয়৷ সেকেন্ডারি পলিসাইথিমিয়া তুলনায় বেশি হয়৷ এর মূলে থাকে নানা কারণ৷ যেমন—
পাহাড়ি এলাকায় বাতাসে অক্সিজেন কম থাকে বলে শরীর বেশি হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। কারণ এর মাধ্যমে বেশি অক্সিজেন ধরে সে শরীরের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে। এতে এই রোগের সূত্রপাত হয়৷ সায়ানোটিক হার্ট ডিজিজ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ইত্যাদি অসুখে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়৷
রোগ দীর্ঘ দিন ধরে চললে শরীর বেশি হিমোগ্লোবিন তৈরি করে কম অক্সিজেনে কাজ চালানোর চেষ্টা করে৷কিছু জেনেটিক সমস্যা, কিডনি বা লিভার ক্যান্সার ও কুশিংস সিনড্রোম নামের অসুখে ও নিয়মিত অ্যানাবোলিক স্টেরয়েড, টেস্টোস্টেরন বা এরিথ্রোপোয়েটিন নিলে রোগ হতে পারে৷
দীর্ঘ দিন ধরে প্রচুর ধূমপান করলে বা খুব বেশি পরিবেশ দূষণের মধ্যে কাজ করলে এই অসুখ আক্রমণ করে। গ্যারেজে, মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ করলে এই রোগের আশঙ্কা থাকে৷ কায়িক পরিশ্রমের কাজ করেন এমন উদ্বেগপ্রবণ মধ্যবয়সী পুরুষদের এ ধরনের রোগ হতে পারে৷ একে বলে স্ট্রেস পলিসাইথিমিয়া৷
কী দেখে বুঝবেন: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা না করলে কিছু বোঝা যায় না৷ গাল বা মুখ, হাত, পায়ের তলা একটু লালচে হতে পারে৷ কালশিটে পড়তে পারে৷মাথাব্যথা,চুলকানি, ক্লান্তি, মাথাঘোরা, পেটে ব্যথা থাকে অনেকের৷ নাক, পাকস্থলি বা অন্ত্রে রক্তপাত হয় কিছু ক্ষেত্রে৷ ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গাউট হতে পারে। সঙ্গে কোমর–পাঁজরে লাগাতার ব্যথা হয়৷ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, পালমোনারি এমবলিজম বা ডিপ ভেন থ্রম্বোসিসের চান্স বাড়ে৷ রক্তচাপ বাড়ে কারও৷ রোগ থাকতে থাকতে প্লীহা (স্প্লিন) ও লিভার বড় হয়ে যেতে পারে৷
চিকিৎসা:রুটিন রক্ত পরীক্ষায় হিমোগ্লোবিন বেশি পাওয়া গেলে রোগীকে পরীক্ষা করে দেখা হয়৷ তাঁর এবং তাঁর পরিবারে কী সমস্যা আছে, তিনি কী কাজ করেন ইত্যাদি জানার পরে আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়। কিছু না পাওয়া গেলে বোনম্যারো পরীক্ষা করতে হয়৷ প্রাইমারি রোগে তেমন জটিলতা না থাকলে চিকিৎসা ছাড়াই রোগী ভাল থাকেন৷ সেকেন্ডারি পলিসাইথিমিয়ায় রোগের কারণ দূর হলে সমস্যা কমে যায় সচরাচর৷ জলশূন্যতা যাতে না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হয়৷ আয়রন সাপ্লিমেন্ট খাওয়া ও ধূমপান করা নিষেধ থাকে৷
কাজকর্ম–খেলাধুলায় তেমন কোনও বারণ নেই৷ তবে পিলে বড় হয়ে গেলে পেটে ধাক্কা লাগে এমন খেলা না খেলাই ভাল৷ প্রাইমারি পলিসাইথিমিয়ার মূল চিকিৎসা মাঝেমধ্যে এক–আধ বোতল করে রক্ত বার করে নেওয়া৷ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে প্রথম দিকে ২–৩ দিন বাদে বাদে করতে হয়৷ অবস্থা স্থিতিশীল হলে এর পর করা হয় অবস্থা অনুযায়ী৷ এই পদ্ধতির নাম ফ্ল্যাবোটমি৷ রক্ত ডেলা বাঁধার আশঙ্কা থাকলে ওরাল কেমোথেরাপির ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয় অনেক সময়৷ ষাটোর্ধ্ব মানুষ, ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ আছে, রক্তে প্লেটলেট বেড়ে গিয়েছে— এমন হলে এই ওষুধে বেশ ভাল কাজ হয়৷ ফ্ল্যাবোটমির ধকল সামলাতে না পারলেও এই ওষুধ দেওয়া হয়৷
রক্ত ডেলা বাঁধার প্রবণতা কমাতে অ্যাসপিরিন দেওয়া হয় কিছু ক্ষেত্রে৷ ফ্ল্যাবোটমির সঙ্গে এই ওষুধ খেলে ফলাফল খুব ভাল হয়৷ তবে রক্তপাতের ইতিহাস থাকলে এই ওষুধ দেওয়া যায় না৷ নিয়মিত ফলো আপ করে যেতে হয়৷ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস এবং পালমোনারি এমবলিজমের প্রবণতা থাকলে,নাক বা পাকস্থলিতে রক্ত ক্ষরণের আশঙ্কা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা দরকার৷ তবে এই ধরনের বিপদ একটু কমই হয়৷