গাফুর আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ক্ষমা। ইসলামী পরিভাষায় অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও করুণা দেখিয়ে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া ও তার প্রতি সহনশীলতা ও উদারতা প্রদর্শন করাকে আ’ফউ বা ক্ষমা বলা হয়। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। খেলাফতের দায়িত্ব পালনে যেসব সিফাত বা গুণ অর্জন করা প্রয়োজন তার মধ্যে আ’ফউ তথা ক্ষমা অন্যতম। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি সর্বদা তার বান্দাদের অপরাধ ক্ষমা করে থাকেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে গফুর ও গাফফার নামে তাকে অভিহিত করা হয়েছে। যদি আল্লাহ তার বান্দাদের ক্ষমা না করতেন তাহলে দুনিয়াতে কোনো মানুষই রেহাই পেত না। এজন্য যে ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমা গুণ অবলম্বন করে অপর মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। যদি (বিবাহ) মোহর ঠিক করার পর স্পর্শ করার আগেই (স্ত্রীকে) তালাক দিয়ে দাও তাহলেও তাকে মোহর দিয়ে দিতে হবে। অবশ্য যদি নারীরা ক্ষমা করে দেয় তবে তা আলাদা কথা। আর তোমরা যদি ক্ষমা করো, তবে তা হবে পরহেজগারির নিকটবর্তী। আর পারস্পরিক সহানুভূতির কথা ভুলে যেও না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সবই অত্যন্ত ভালো করে দেখেন। (সূরা আল বাকারাহ : ২৩৭) যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় (আল্লাহর রাস্তায়) খরচ করে যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষকে ক্ষমা করে, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা মুহসিন লোকদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে-ইমরান : ১৩৪) তোমরা যদি কল্যাণ করো প্রকাশ্যভাবে কিংবা গোপনে অথবা যদি তোমরা অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তবে জেনে রেখো আল্লাহ নিজেও ক্ষমাকারী, মহাশক্তিমান। (সূরা আন্ নিসা: ১৩৪)
ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোলো, ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খ জাহেলদের (কথাবার্তা) থেকে দূরে থাকো। (সূরা আ’রাফ : ১৩৪) আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখনই রাসূলুল্লাহ সা:কে দু’টি কাজের মধ্যে একটি গ্রহণ করার এখতিয়ার দেয়া হতো, তখন তিনি তা থেকে সহজটি গ্রহণ করতেন। যদি তাতে গুনাহের কিছু না থাকত। আর যদি তা গুনাহের কোনো কাজ হতো, তবে তিনি তা থেকে বহু দূরে থাকতেন। আর রাসূলুল্লাহ সা: নিজের জন্য কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। তবে যদি কেউ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কোনো হারাম কাজে লিপ্ত হতো, তখন তিনি আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য তাকে সে গুনাহের জন্য শাস্তি দিতেন। (যেমন জিনার জন্য রজম এবং চুরির জন্য হাত কাটার শাস্তি ইত্যাদি।) (আবু দাউদ হাদিস-৪৭৮৫ হাদিসটি সহিহ)
যারা আক্রান্ত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। আর মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। যে ক্ষমা করে আপস করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে, নিশ্চয় তিনি জালিমদের পছন্দ করেন না। অবশ্য যে অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে যারা মানুষের ওপর অত্যাচার চালায় এবং দুনিয়াতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে পীড়াদায়ক শাস্তি। অবশ্য যে সবর করে ও ক্ষমা করে, নিশ্চয় এটা অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ। (সূরা আশ শুরা : ১৩৪)
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : সাদকা করাতে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম ৭ম খণ্ড অ: সদ্ব্যবহার, আত্মিয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, পৃ: ১১৪)
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয় লাভ করাতে বীরত্ব নেই। বরঞ্চ ক্রোধ ও গোস্বার মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্বের পরিচয়। (বোখারি ৯ম খণ্ড অ: আচার-ব্যবহার পৃ: ৪৫৩) আবুল আহওয়াস তার পিতা (মালিক ইবন নাজলা) রা: থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সা: যখন কোনো ব্যক্তির নিকট দিয়ে আমি যাই কিন্তু সে ব্যক্তি আমার মেহমানদারি করে না, সে যদি আমার নিকট দিয়ে যায় তবে কি আমি তার সাথে অনুরূপ আচরণ করে বদলা নিতে পারি? তিনি বলেন, না, বরং তুমি তার মেহমানদারি করবে। মালিক রা: বলেন, আমার পরনে তিনি অত্যন্ত পুরনো হয়ে যাওয়া কাপড়ে দেখে বললেন, তোমার ধন-সম্পদ আছে কি? আমি বললাম, উট, ছাগল, সব ধরনের সম্পদ, আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তিনি বললেন, তোমার মাঝে এর নিদর্শন যেন পরিলক্ষিত হয়। (তিরমিজি হাদিসটি সহিহ)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা যেন ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের প্রতি ক্ষমার প্রতিফলন ঘটাতে পারি।
লেখক : নিবন্ধকার