১৯০৬ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার পার্সিবাগান স্কোয়ারে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক সভায় প্রথম ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলিত হয়। এই পতাকা উত্তোলন করেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু। পতাকাটি কলকাতা পতাকা নামে পরিচিত হয়। এই পতাকায় উপরে, মধ্যে ও নিচে যথাক্রমে কমলা, হলুদ ও সবুজ রঙের তিনটি আনুভূমিক ডোরা ছিল। উপরের ডোরায় আটটি অর্ধ-প্রস্ফুটিত পদ্ম এবং নিচের ডোরায় সূর্য ও অর্ধচন্দ্র অঙ্কিত ছিল। মাঝে দেবনাগরী হরফে লিখিত ছিল "বন্দে মাতরম" কথাটি।[৫]
১৯০৭ সালের ২২ জুলাই জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ভিখাজি কামা অন্য একটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন। এই পতাকার উপরে ছিল সবুজ, মধ্যে গেরুয়া ও নিচে লাল রং। সবুজ রং ছিল ইসলামের প্রতীক ও গেরুয়া হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের প্রতীক। সবুজ ডোরাটির উপর ব্রিটিশ ভারতের আটটি প্রদেশের প্রতীক হিসেবে আটটি পদ্মের সারি অঙ্কিত ছিল। মধ্যের ডোরায় দেবনাগরী হরফে "বন্দে মাতরম" কথাটি লিখিত ছিল এবং নিচের ডোরায় পতাকাদণ্ডের দিকে অর্ধচন্দ্র ও উড্ডয়নভাগের দিকে একটি সূর্য অঙ্কিত ছিল। ভিখাজি কামা, বীর সাভারকর ও শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা একযোগে এই পতাকাটির নকশা অঙ্কন করেছিলেন।[৫] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বার্লিন কমিটিতে ভারতীয় বিপ্লবীরা এই পতাকাটি গ্রহণ করেন। সেই থেকে এটি বার্লিন কমিটি পতাকা নামে অভিহিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ায় সক্রিয়ভাবে এই পতাকাটি ব্যবহৃত হয়েছিল।[৬] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গদর পার্টি পতাকাটি কিছু সময়ের জন্য ভারতের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[৭]
১৯১৭ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্ত পরিচালিত হোমরুল আন্দোলন একটি নতুন পতাকার জন্ম দেয়। এই পতাকায় পাঁচটি লাল ও চারটি সবুজ আনুভূমিক ডোরা ছিল। উপরের বাঁদিকে আয়তাকার ইউনিয়ন পতাকা ছিল আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষিত ডোমিনিয়ন মর্যাদা লাভের প্রতীক। উপরের উড্ডয়নভাগে ছিল সাদা অর্ধচন্দ্র ও তারা। হিন্দুদের পবিত্র সপ্তর্ষি মণ্ডলের প্রতীকরূপে সাতটি সাদা তারা পতাকায় খচিত ছিল। এই পতাকাটি অবশ্য সর্বসাধারণ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়।[৫]
এক বছর আগে ১৯১৬ সালে অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম শহরের নিকটস্থ ভাটলাপেনামারু গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া একটি সাধারণ জাতীয় পতাকার রূপদানের চেষ্টা করেন। তার এই প্রচেষ্টা উমর সোবানি ও এস বি বোমানজির চোখে পড়ে। এঁরা একসঙ্গে ভারতীয় জাতীয় পতাকা মিশন হাতে নেন। ভেঙ্কাইয়া এই পতাকার জন্য মহাত্মা গান্ধীর অনুমোদন চাইতে গেলে গান্ধীজি তাকে "ভারতের মূর্তপ্রতীক ও দেশের সকল অমঙ্গলহারী" চরকার চিত্র পতাকায় যোগ করার পরামর্শ দেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রদর্শিত পথে হস্তচালিত চরকা ছিল ভারতের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক। ভেঙ্কাইয়া লাল ও সবুজ প্রেক্ষাপটে চরকার ছবি সংবলিত একটি পতাকা প্রস্তুত করেন। কিন্তু গান্ধীজি মনে করেন, এই পতাকাটিতে ভারতের সকল ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতিফলন ঘটেনি।[৮]
মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছানুসারে একটি নতুন পতাকার নকশা করা হয়। এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার উপরে ছিল সাদা, মধ্যে সবুজ ও নিচে নীল; যা যথাক্রমে সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়, মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতীক। তিনটি ডোরা জুড়ে খচিত ছিল চরকার ছবি। আনুভূমিক তেরঙা ডোরা সংবলিত এই পতাকাটি আয়ারল্যান্ডের জাতীয় পতাকার সমরূপ ছিল। উল্লেখ্য, আয়ারল্যান্ডের পতাকা আরেকটি প্রধান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক।[৪] জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে এটি উত্তোলিত হয়। যদিও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কখনই এটিকে সরকারি পতাকা হিসেবে গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনে এর ব্যাপক প্রয়োগও অন্যদিকে চোখে পড়ে না।
পতাকার এই সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অনেকের মনেই অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ১৯২৪ সালে কলকাতায় সর্বভারতীয় সংস্কৃত কংগ্রেস হিন্দুধর্মের প্রতীক রূপে গেরুয়া রং ও বিষ্ণুর গদার চিত্র পতাকায় সংযোজনের প্রস্তাব দেয়। এই বছরই "হিন্দু যোগী ও সন্ন্যাসী এবং মুসলমান ফকির ও দরবেশদের মধ্যে প্রচলিত ত্যাগের প্রতীক" গেরু বা গিরিমাটি রং পতাকায় যোগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শিখেরা দাবি তোলে, হয় তাদের প্রতিনিধিরূপে হলুদ রং পতাকায় রাখতে হবে, নয়তো পতাকা থেকে ধর্মীয় প্রতীকতত্ত্ব বাদ দিতে হবে।
এই সব দাবির প্রেক্ষাপটে সমস্যা সমাধানের লক্ষে ১৯৩১ সালের ২ এপ্রিল কংগ্রেস কর্মসমিতি একটি সাত সদস্যের পতাকা সমিতি গঠন করে। "পতাকায় ব্যবহৃত তিনটি রং নিয়ে আপত্তি আছে; কারণ এই রংগুলি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে চিহ্নিত" – এই মর্মে একটি প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু এই সকল অপ্রাতিষ্ঠিনিক আলাপ-আলোচনার ফলস্রুতিটি হয় অভাবনীয়। পতাকায় একটিমাত্র রং হলদেটে কমলা রাখা হয় এবং উপরের দণ্ডের দিকে চরকার চিত্র খচিত হয়। পতাকা সমিতি এই পতাকাটির প্রস্তাব রাখলেও, সমগ্র প্রকল্পে সাম্প্রদায়িক ভাবধারার প্রতিফলন ঘটেছে মনে করে, কংগ্রেস এই পতাকা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।