ইসলামে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয় ইসলামে প্রাচীন কাল থেকেই যোগ নিয়ে চিন্তাভাবনা৷ তবে সেই চিন্তার ধাঁচধরন সঙ্ঘ পরিবারের ইসলামি শাখা ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’-এর থেকে ঢের বেশি গভীর৷
প্রথমেই আসা যাক মহম্মদ হাফিজুল-এর প্রসঙ্গে৷ হাফিজুল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং আশৈশব যোগ ব্যায়ামে আগ্রহী৷ বিশ্ব যোগ দিবস উপলক্ষ্যে তাই হাফিজুলের উত্সাহ স্বাভাবিক৷ কিন্ত্ত সে তার এই উত্সাহকে বাস্তবায়িত করতে অসফল৷ হাফিজুলের ক্রীড়াচর্চার পথে বাধ সেধেছে তার ধর্মাচার৷ হাফিজুলের মতে ‘২১ জুন তারিখটায় একটু সমস্যা রয়েছে৷ আসলে ১৮ তারিখ থেকে রমজান পড়ায় সারা দিন আমাদের রোজার উপোস রাখতে হয়৷ এমনিতেই গ্রীষ্মে রোজা পালন করা বেশ কষ্টকর৷ উপরন্ত্ত উপবাসে শারীরিক ভাবে অভ্যস্ত হতে এক সপ্তাহ সময় পেরিয়ে যায়৷ সাধারণ মুসলমান সম্পর্কে সচেতন হলে আয়োজকেরা ২১ তারিখ দিনটা কখনওই নির্বাচন করতেন না৷ এর মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে একটা অবজ্ঞা এবং মুসলমান মানুষের প্রতি সহানুভূতির অভাব প্রচ্ছন্ন৷ তাই মনে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শারীরিক কারণে যোগ দিবসে যাওয়া হল না৷’
তবু যুক্তি দেওয়া যেতে পারে আয়োজনের শত ত্রুটি সত্ত্বেও যোগ সম্পর্কে জনমানসে একটা আন্তরিক সচেতনতার জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে৷ হতে পারে, কিন্ত্ত এই বিষয়ে কিছু অনিশ্চিত কণ্ঠস্বরও শোনা যচ্ছে৷
লাভপুর সত্যনারায়ণ শিক্ষানিকেতনের প্রধান শিক্ষিকা মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘স্বাস্থ্য সম্পর্কে যে কোনও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াসই ভালো কথা৷ কিন্ত্ত সেই সচেতনতার চরিত্র সম্পর্কে ভেবে দেখা অত্যন্ত জরুরি৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফিজিকাল এডুকেশন পাঠ্যক্রমে যোগব্যায়াম রয়েছে অনেককাল৷ আমাদের স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রীই ইসলাম সম্প্রদায়ভুক্ত৷ এ যাবত্ যোগ সম্পর্কে আলাদা কোনও প্রতিরূপ বা বিরূপ মনোভাবের পরিচয় তাদের মধ্যে পাইনি৷ তবে আমি সন্দিহান, এই মাতামাতির প্রভাবে তারা যোগ ব্যায়ামকে হিন্দু ধর্মাচরণ ভেবে না বসে৷ আগামী দিনে এই রকম প্রশ্নের সম্মুখীন শিক্ষকরা হতেই পারেন৷ বিশ্ব যোগ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়োজনের আধিক্য যোগকে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নিয়ে এল৷ তবে আমি এও বলব যে, যোগ দিবস পালনের কোনও বাধ্যবাধকতা পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাদের উপর আরোপ করেননি৷’
বিশ্ব যোগ দিবস ঘিরে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে স্বাভাবিক ভাবেই জড়িয়ে পরেছে ভারতের অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আপামর মুসলমান সমাজে জমিয়ত তার উদারবাদী আদর্শের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত৷ ১৯৪৫ সালে মুসলিম লিগ প্রবর্তিত দেশভাগ প্রস্তাবের সোচ্চার বিরোধিতা করে জমিয়ত ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করে ৷ এহেন প্রতিষ্ঠানের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক মওলানা সিদ্দিকুল্লাহ্ চৌধুরী যোগ দিবসের রাজনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনোভাব পোষণ করেন৷ তার মতে, ‘স্বাস্থ্যরক্ষার প্রসঙ্গে কোনও ধার্মিক নিষেধাজ্ঞা না থাকাই উচিত৷ যোগ সম্পর্কে আলাদা করে ইসলাম ধর্মে কোনও বিধি-নিষেধ নেই৷ কিন্ত্ত মুসলমান সমাজের কিছু আদব কায়দা সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত৷ যেমন নারী পুরুষের একত্রে ক্রীড়া অনুশীলনের কিছু বারণ ইসলামে রয়েছে৷ সেগুলিকে সম্মান করে যোগাভ্যাস করা উচিত৷ বিশেষত সেটি যখন জনসমক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ যোগের একটা অনস্বীকার্য্য ‘স্পিরিচুয়াল’ চরিত্র রয়েছে৷ যদি এই ‘স্পিরিচুয়ালিজম’ বজায় রেখে যোগাভ্যাস করা হয় তা হলে ইসলাম বিধিসম্মত হবে না৷ হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মে ঐশ্বরিকতার ধারণা দু’টি স্বতন্ত্র, যা অনেক ক্ষেত্রেই অসামঞ্জস্য বহন করে৷ আমি যত দূর জানি আরএসএস-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ইসলাম ধর্মে সালাত্ (নমাজ) নাকি এক ধরনের যোগাসন৷ এই তথ্য তারা কোথায় পেলেন তা আমার জানা নেই৷ কিন্ত্ত আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল৷ এই প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে অপমান করার চক্রান্ত হচ্ছে৷ সালাত্ মানে শুধু দৈহিক পরিচর্যা নয়, এর গভীর ধার্মিক তাত্পর্য রয়েছে৷ সালাত্-এর মহান উদ্দেশ্যকে খর্ব করার প্রচেষ্টা আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্পষ্ট৷ যেহেতু প্রচারযন্ত্র বর্তমানে বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তারা নিরন্তর ইসলামের বিরুদ্ধে তার অপপ্রয়োগ করে চলেছে৷’ মওলানা চৌধুরী আরও বলেন, ‘যদি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সরকার এতোটাই উদ্বিগ্ন তা হলে তাদের উচিত অবিলম্বে দূষণ, মাদকদ্রব্য, ভেজাল খাবার, জালি ওষুধ, অপুষ্টি ও অনাহারের দিকে দৃষ্টিপাত করা৷ এগুলিকে অবহেলা করে এমন এক বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা হচ্ছে যার সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক পরোক্ষ৷ তাই সরকারের উদ্দেশ্য ঈষত্ সন্দেহজনক৷ যোগ নিয়ে এই আয়োজন-উদ্যাপনের নীচে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির চোরাস্রোত অনুভব করা মোটেই কঠিন নয়৷’
নটে গাছটি মুড়োনোর আগে ভারতীয় মূল্যবোধের মুরুব্বিদের উদ্দেশ্যে একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত পেশ করছি৷ দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের বাসিন্দা, বসির মণ্ডল৷ তিরিশোর্ধ্ব বসির পেশায় ক্ষেতমজুর৷ তার কথায়, ‘আমাদের মতো গ্রামের লোকেদের ব্যায়াম করার সুযোগ কোথায়? ক্ষেতে খাট তেই সারাদিন চলে যায়৷ আর এইসব ব্য্যমঠ্য্যম শহুরে লোকেদের প্রয়োজন হয়, আমাদের নয়৷ তবে মাঝে মাঝে টিভিতে মেমসাহেবদের এই সব করতে দেখি৷’