মিলিবাগ
মনে করুন আপনি একজন সফল বাগানি। আপনার বাগানে আছে অনেক ধরণের গাছ। তারা নিয়মিত ফুল দিচ্ছে, ফল দিচ্ছে। হঠাৎ একদিন দেখলেন কোন একটি গাছের পাতার নিচে ছোট্ট একটি সাদা তুলোর মত জমে আছে। ভাবলেন, হয়ত তুলোই হতে পারে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল বাগানের সব গাছের পাতার নিচে, পাতার গোড়ায় এমন সাদা সাদা তুলোর মত। দিন দিন এমন তুলোর পরিমাণ বাড়তে লাগল আর ফলনের পরিমাণ কমতে লাগল। গাছগুলোর পাতা এলোমেলোভাবে কুঁকড়ে গেল, ফুল দেওয়া কমে গেল, ফল দেওয়া কমে গেল। কিছুদিন বাদে দেখা গেল গাছগুলোর পাতা কালচে আবরণে ঢেকে যাচ্ছে। গাছ দূর্বল হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। অথচ আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। নিশ্চিত থাকুন যে আপনার সাধের গাছ মিলিবাগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। যদি সময়মত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে ক্ষতির আশঙ্কা সর্বাধিক।
মিলিবাগগুলো আকারে ছোট, ২.৫ – ৪ মিলিমিটার হলেও এদের মধ্যে জায়ান্ট মিলিবাগ সত্যিকার অর্থেই দৈত্যাকার। প্রায় ১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত এটি হতে পারে। স্ত্রী পোকার পাখা নেই বলে উড়তে পারে না এবং নিম্ফের মত দেখায়। তবে স্কেল পোকার সাথে সাদৃশ্য থাকলেও স্ত্রী মিলিবাগ হাটতে পারে। পুরুষ পোকাটি অনেকটা বোলতার মত দেখতে, কিন্তু আকারে স্ত্রী পোকার চেয়ে অনেক ছোট। জীবনের প্রথমাবস্থায় নিম্ফ থাকে পরে বোলতার মত পাখা সমৃদ্ধ আকার ধারণ করে। পুরুষ পোকার আয়ুস্কাল খুবই কম। পূর্নবয়স্ক পুরুষ পোকার মুখ থাকে না বলে সে খাদ্য গ্রহণ করে না এবং স্ত্রী পোকার সাথে মিলনের পরেই মারা যায়। এদিকে স্ত্রী মিলিবাগই হচ্ছে আমাদের প্রধান শত্রু। এরা ক্রমাগত গাছের রস শোষন করতে থাকে চুষে রস খাওয়ার উপযোগী মুখ দিয়ে। আক্রমনের প্রথমে গাছের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে পাতার গোড়ায়, কান্ডের ফাক ফোঁকরে তুলার আশ বা মোমের গুড়ার মত বস্তু দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো মূলত মিলিবাগের জমাটবাধা ডিম অথবা খুব ছোট মিলিবাগ। এই তুলার আশের মত বস্তুগুলো আসলে মোমের মত এক ধরণের পদার্থ। মোমের গুড়ার ইংরেজি হল মিলি (mealy)। সেই থেকে এই পোকার নাম হয়েছে মিলিবাগ। আক্রমন বাড়লে অনেকগুলো কীটকে একসাথে কলোনি বানিয়ে থাকতে দেখা যায়। মিলিবাগের সংক্রমন আরো বেড়ে গেলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়, হলদে হয়ে যায়, পাতা ঝরে যায়, ফুল বা মুকুল ও ফল ঝরে পরে, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মজার ব্যাপার হল এই যে Homoptera গ্রুপের আর সব স্কেল পোকার মতই মিলিবাগও মধু নিঃসরণ করে ক্রমাগত। নিঃসৃত মধুর উপর সংক্রমন হয় শুটি মোল্ড ছত্রাকের। এর ফলে গাছের পাতার উপর কালো প্রলেপ পড়ে, পাতা পর্যাপ্ত আলো পায় না, খাদ্য তৈরি ব্যহত হয়।এতে উদ্ভিদ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পরে এবং পাতা শুকিয়ে হলদে হয়ে ঝরে পরে। আরো ভয়ের ব্যাপার হল এই যে মিলিবাগ বিভিন্ন ধরণের ভাইরাসের বাহক হিসাবে কাজ করে।সর্বশেষ ধাক্কা আসে ভাইরাসের আক্রমনের মধ্য দিয়ে। আঙ্গুরের পাতা কোকড়ানো রোগ (Grapevine leaf roll disease), কলার দাগ ধরা রোগ (Banana streak disease), আনারসের ঢলে পড়া রোগ (Pineapple wilt) সহ Caulimoviridae এবং Closteroviridae পরিবারের ভাইরাস সমূহের ছড়ানোর জন্য দায়ী করা যায় মিলিবাগকে। এতে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়, জমাট বেঁধে যায় এবং ফলন চরমভাবে ব্যাহত হয় (Herrbach 2015)। মানুষের সংস্পর্শে এলে তেমন ক্ষতি না হলেও কিছু কিছু মিলিবাগের কারণে চুলকানি, এলার্জি, শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
এপ্রিল মে মাসের দিকে সাধারনত মিলিবাগ ডিম পাড়ে। বেশিরভাগ মিলিবাগের প্রজাতিতে পার্থেনোজেনেসিস পদ্ধতিতে স্ত্রী পোকা পুরুষের সাহায্য ছাড়াই ডিম উৎপাদন করতে পারে। তবে কিছু কিছু প্রজাতিতে স্ত্রী এবং পুরুষের মিলনের প্রয়োজন হয়। জায়ান্ট মিলিবাগে, হিবিসকাস মিলিবাগ স্ত্রী ও পুরুষ পোকা মিলনের পর দল বেঁধে স্ত্রী পোকাগুলো হেঁটে হেঁটে মাটিতে নেমে আসে। মাটির ৫-১৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় প্রতিটি স্ত্রী পোকা গুচ্ছাকারে মোমের আবরণের ভেতরে প্রজাতি ভেদে ৩০০-৪০০ টি ডিম দেয়। অবশ্য কিছু প্রজাতি গাছের পাতার বোটায়, বাকলের ভাজে, কচি ডগায় প্রায় ৬০০ টির মত ডিম দেয়। আবার আনারসের মিলিবাগের প্রজাতির ডিম স্ত্রী পোকার ভেতরেই বড় হয় এবং পরে সরাসরি বাচ্চা দেয়। সাধারণত ডিম দেওয়া শেষে স্ত্রী পোকাগুলো মারা যায়। জায়ান্ট মিলিবাগের মাটির নিচের ডিমগুলো নভেম্বর মাসে ফোটা শুরু হয় এবং তা চলে প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত। ডিম ফুটে গোলাপি আভাযুক্ত ছোট ছোট মিলিবাগের নিম্ফ হেঁটে হেঁটে গাছের উপর উঠে পড়ে এবং কচি ডালপালা, কচি ডগা, কচি পাতা, পুষ্পমঞ্জরি ও ফলের বোটা থেকে রস চুষে খেতে শুরু করে। অন্যান্য প্রজাতির মিলিবাগের ডিম ফুটতে ৩-৯ দিন সময় লাগে এবং ৩০ দিনের মধ্যেই পূর্নাংগ রূপ নেয়। পুরুষ পোকা বেঁচে থাকে ২২-২৫ দিন পর্যন্ত। এভাবে প্রজাতিভেদে মিলিবাগ ১ বছরে ১৫ বার বংশবিস্তার করতে পারে।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল মিলিবাগের সাথে পিপড়ার সহাবস্থান। পিপড়া মিলিবাগের নিঃসৃত মিষ্টি মধু খেতে পছন্দ করে। তাই বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় যেখানে মিলিবাগ আছে সেখানে পিপড়াও আছে। প্রাচীন ডমিনিকান এম্বারে আটকে পড়া ফসিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে মায়োসিন যুগে অর্থাৎ প্রায় ১৬ মিলিয়ন বছর আগে Acropyga জেনাসের পিপড়ার সাথে Electromyromococcus জেনাসের মিলিবাগের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এটিই মিলিবাগ এবং পিপড়ার সহাবস্থানের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন। খেয়াল করলে দেখবেন বর্তমান পৃথিবীতেও সেই একই রকম সহাবস্থান রয়েছে। পিপড়ারা অ্যাফিড, স্কেল পোকার মতই মিলিবাগও লালন পালন করে থাকে মিষ্টি রসের জন্য। খেয়াল করলে দেখা যায় পিপড়া ছোট ছোট মিলিবাগের নিম্ফগুলোকে কচি ডগায় পৌছাতে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে মুখে করে তুলে দ্রুত বহন করে নিয়ে যায়। নিম্ফ মাটিতে পড়ে গেলে পিপড়া তাদের আবার তুলে গাছের উপর উঠিয়ে দেয় (Johnson et al. 2001)।
প্রতিকার:
এতক্ষন আমরা জানলাম শত্রুর পরিচিতি। এখন জানা বাকি শত্রু আয়ত্তে আনার রনকৌশল। মিলিবাগের প্রধান ঢাল হল তার মোমের মত আবরণ। এ আবরণের কারণে সাধারণ কীটনাশক তার গায়ের ত্বক পর্যন্ত পৌছায় না সহজে। তাই কীটনাশক দেওয়ার পরেও মিলিবাগ বহাল তবিয়তেই বেঁচে থাকে। এর জন্য দরকার সমন্বিত বালাই ব্যাবস্থাপনা। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের সংস্কৃতের অর্থশাস্ত্রের প্রাচীন প্রবাদ- শত্রুর শত্রু হয় বন্ধু। তার অর্থ দাঁড়ায় শত্রুর বন্ধুও শত্রু। সহজেই বোধগম্য যে মিলিবাগ কে আয়ত্তে আনতে চাইলে তাকে দূর্বল করার মোক্ষম অস্ত্র হল তার বন্ধু পিপড়া কে হটিয়ে দেওয়া। আর তা হলেই মিলিবাগ অর্ধেক দূর্বল হয়ে পড়বে। পিপড়া দূর করার জন্য উন্নত বিশ্বে বৈদ্যুতিক বেড়া ব্যাবহার করা হয় যেখানে পিপড়া বৈদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশ করতে পারেনা। অথবা সোহাগা বিষ টোপ দিয়েও পিপড়া নির্মূল করা যায়। এই পদ্ধতিতে সোহাগা এবং চিনি / মধু ১:৩ অনুপাতে ভালোভাবে গুলিয়ে ক্ষেতের বা বাগানের বিভিন্ন স্থানে রেখে দিলে পিপড়া এসে সেটি খায় এবং ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা পরে। যারা ছাদ বাগানের পিপড়া তাড়াতে চান তারা ১ ভাগ ভিনেগারের সাথে ২ ভাগ পানি মিশিয়ে সেই অম্লীয় দ্রবন দিয়ে ছাদ পরিস্কার করে নিতে পারেন। তাতে পিপড়ার উপদ্রব কমে আসবে।
পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কিছু সহজ পদ্ধতি আবলম্বন করে মিলিবাগের আক্রমন কমিয়ে আনা যায়। আগের
বছরের সংক্রমিত ফসলের উচ্ছিষ্ট এবং আগাছা থেকে নতুন ফসলে কীট সহজেই ছড়াতে পারে। তাই, উচ্ছিষ্ট এবং আগাছা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখতে পারলে পিপড়ার এবং মিলিবাগের আশ্রয় ধ্বংস হয় এবং আক্রমন অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। মালভেসি গোত্রের গাছে সহজেই মিলিবাগ আক্রমন করে। তাই শস্যের আশেপাশের মালভেসি গোত্রের গাছ তুলে ফেলাই ভাল হবে। এক জমির ব্যাবহৃত যন্ত্রপাতি অন্য জমিতে ব্যাবহার করার আগে খুব ভালভাবে পরিস্কার করে নিতে হবে। চিকন ধারায় পানি স্প্রে করে মিলিবাগ কে গাছ থেকে ফেলে দেওয়া যেতে পারে। মিলিবাগ দ্রুত নড়তে পারে না বলে খুব সহজে উপরে উঠতে পারে না। বহুবর্ষজীবি গাছে আলগা হয়ে থাকা বাকলে মিলিবাগ ডিম পাড়ে এবং লুকিয়ে থাকে। এসব আলগা হয়ে থাকা বাকল তুলে ফেলে ডাইক্লোরভস ৭৬ ইসি ২মিলি + ২গ্রাম মাছের তেল ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সে জায়গায় স্প্রে করলে ভাল কাজ দেবে। গাছের কান্ডে চওড়া করে আঠালো ফাঁদ ব্যাবহার করেও মিলিবাগ আটকানো যাবে।
যদি কিছুতেই কিছু না হয় এবং মিলিবাগের সংখ্যা যদি এতই বেশি হয় যে আর কোনভাবেই তাদের আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না তবে শেষ অস্ত্র হিসেবে বাকি থাকে কেমিক্যাল ব্যাবহার করা। নিম্নোক্ত কেমিক্যাল গুলো ব্যাবহার করলে নিশ্চিতভাবে এই যুদ্ধে সহল হওয়া যাবে।
পিপড়া মারতে-
১। ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসি – ২.৫ মিলি/লিটার
২। ৫% ম্যালাথিওন পাউডার – ২৫ কেজি/হেক্টর
মিলিবাগের উপর সরাসরি ব্যাবহার করার জন্য-
১। ডাইক্লোরভস ৭৬ ইসি- ২.৫ মিলি/লিটার
২। মনোক্রটোফস ৩৬ ডব্লিউএসজি- ১.৫ মিলি/লিটার
৩। মিথাইল ডিমেটন ২৫ ইসি – ২ মিলি/লিটার
৪। ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসি – ২.৫ মিলি/লিটার
৫। ইমিডাক্লোপ্রিড ২০০ এসেল- ২ মিলি/লিটার
৬। ম্যালাথিওন ২.৫ মিলি/লিটার
এই কেমিক্যালের কোন একটি অথবা যৌথভাবে ১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই কেমিক্যালগুলো খুবই বিষাক্ত এবং স্প্রে করার পর ১৫ দিন ফসল তোলা যাবে না। স্প্রে করার সময় মাস্ক, গ্লাভস এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা আবলম্বন করতে হবেই। আরো একটি ব্যাপার মনে রাখার মত, তা হল কেমিকেলের প্রতি কীট পতংগের প্রতিরোধী ক্ষমতা। যদি অল্প মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় তবে কীট মরবে না বরং পরের বংশধারায় ওই কীটনাশকের প্রতি সহনশীলতা তৈরি হবে এবং কীট মরবে না। তাই অবশ্যই উপদেশকৃত মাত্রায় কেমিক্যাল প্রয়োগ করতে হবে এবং কিছুদিন পর পর কেমিক্যাল গ্রুপ পরিবর্তন করতে হবে।
পাঠক, হয়ত মনে প্রশ্ন জাগছে, হয়ত বিরক্ত হচ্ছেন, ভাবছেন আসলেই মিলিবাগ নিয়ে খুব চিন্তার কিছু আছে কি? ভেবে দেখুন, এটি এই মুহুর্তে যদিও আমাদের প্রধান শত্রু নয়, তার পরেও বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জমিতে এবং বাগানে বিশেষ করে ফলের বাগানগুলোতে এবং ছাদবাগানে এর উপস্থিতি বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। জায়ান্ট মিলিবাগ বছরে মাত্র একবার বংশবৃদ্ধি করলেও অন্যান্য মিলিবাগের প্রজাতি বছরে ১৫ টি বংশ বিস্তার করতে পারে। অর্থাৎ একটি মিলিবাগ থেকে যদি গড়ে ৫০ টি ও পূর্নাংগ মিলিবাগ হতে পারে তবে ১ বছরে সেই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০১২০। তাহলে ভেবে দেখুন সংখ্যাটি কত বিশাল। যদি এদের এখনি আয়ত্তে না আনা হয় তবে মহামারী ধারণ করতে কতদিন?
ঘরেই বানিয়ে ফেলুন মিলিবাগের ঔষধ:
১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ডিটারজেন্ট এবং ৪-৫ ফোটা নিম তেল বা সযাবিন তেল পানিতে মিশিয়ে পড়ন্ত বিকালে স্প্রে করুন।
(সংগ্রহিত)