সূরা আল-ফালাক (আরবি: سورة الفلق; নিশিভোর) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের ১১৩ তম সূরা; এর আয়াত, অর্থাৎ বাক্য সংখ্যা ৫ এবং রূকু, তথা অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১। সূরা আল-ফালাক মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে; যদিও কোন কোন বর্ণনায় একে মক্কায় অবতীর্ণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর পাঁচ আয়াতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার জন্য সংক্ষেপে আল্লাহর নিকট প্রার্থণা করা হয়। এই সূরাটি এবং এর পরবর্তী সূরা আন-নাসকে একত্রে মু'আওবিযাতাইন (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু'টি সূরা) নামে উল্লেখ করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় বা ঘুমের আগে এই সূরাটি পড়া একটি ঐতিহ্যগত সুন্নত।
নামকরণ
সূরা ফালাক ও সূরা আন-নাস আলাদা আলাদা সূরা হলেও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত গভীর ও উভয়ের বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এত বেশি নিকট সম্পর্কিত যে এদেরকে একত্রে “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা) নামে ডাকা হয়; আর এই সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে একই ঘটনার পরি-প্রেক্ষিতে।
শানে নুযূল
সূরা আল ফালাক ও পরবর্তী সূরা নাস একই সাথে একই ঘটনায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে, জনৈক ইহু্দী রসূলুল্লাহ্- এর উপর জাদু করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিবরাঈল আগমন করে সংবাদ দিলেন যে, জনৈক ইহু্দী জাদু করেছে এবং যে জিনিসে জাদু করা হয়েছে, তা অমুক কুপের মধ্যে আছে। রসুলুল্লাহ লোক পাঠিয়ে সেই জিনিস কূপ থেকে উদ্ধার করে আনলেন। তাতে কয়েকটি গিরু ছিল। তিনি এই সূরা দুটি পড়ে ফুক দেওয়ায় গিরুগুলো সাথে সাথে খুলে য়ায এবং সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শয্যা ত্যাগ করেন।[৬]
হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত আছে, রসুলুল্লাহ - এর উপর জাদু করলে তার প্রভাবে তিনি মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি, তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন। একদিন তিনি হযরত আয়েশা -কে বললেনঃ আমার রোগটা কি, আল্লাহ্ তা'আলা তা আমাকে বলে দিয়েছেন। (স্বপ্নে) দুব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং একজন শিয়রের কাছে ও অন্যজন পায়ের কাছে বসে গেল। শিয়রের কাছে উপবিষ্ট ব্যক্তি অন্য জনকে বলল, তাঁর অসুখটা কি? অন্যজন বললঃ ইনি জাদুগ্রস্ত। প্রথম ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলঃ কে জাদু করেছে? উত্তর হল, ইহুদীদের মিত্র মুনাফিক লবীদ ইবনে আ'সাম জাদু করেছে। আবার প্রশ্ন হলঃ কি বস্তুতে জাদু করেছে? উত্তর হল, একটি চিরুনীতে। আবার প্রশ্ন হল, চিরুনীটি কোথায়? উত্তর হল, খেজুর ফলের আবরণীতে 'বির যরোয়ান' কূপে একটি পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ সে কূপে গেলেন এবং বললেনঃ স্বপ্নে আমাকে এই কূপই দেখানো হয়েছে। অতঃপর চিরুনীটি সেখান থেকে বের করে আনলেন।[৭]
মুসনাদে আহমদের রেওয়ায়েতে আছে, রসুলুল্লাহ -এর এই অসুখ ছয় মাস স্থায়ী হয়েছিল।[৮]
আয়াতসমূহ
আরবি ভাষায় উচ্চারণ বাংলায় অনুবাদ
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম
قُلۡ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلۡفَلَقِ
مِن شَرِّ مَا خَلَقَ
وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
وَمِن شَرِّ ٱلنَّفَّـٰثَـٰتِ فِى ٱلۡعُقَدِ
وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক।
মিন শাররি মাখালাক্ব।
ওয়া মিন শাররি গাসিক্বিন ইযা অক্বাব।
ওয়া মিন শাররিন নাফ্ফাসাতি ফিল্ উকাদ।
ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইযা হাসাদ।
বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার,
তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,
গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে
এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।
হাদিস
আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসায়ীর এক দীর্ঘ রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মিসীবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট হয়। - (ইবনে-কাসীর)[৯]
সহীহ মুসলিমে ওকবা ইবনে আমের -এর বর্ণিত হাদীসে রসূলুল্লাহ বলেনঃ তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, অদ্য রাত্রিতে আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি এমন আয়াত নাযিল করেছেন, যার সমতুল্য আয়াত দেখা যায় না। অর্থা ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক এবং ক্বুল আউযু বিরাব্বিল নাস আয়াতসমূহ। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, তওরাত, ইঞ্জীল, যাবুর এবং কোরআনেও অনুরূপ অন্য কোন সূরা নেই।
এক সফরে রসূলুল্লাহ ওকবা ইবনে আমেন -কে সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পাঠ করালেন, অত:পর মাগরিবের নামাযে এ সূরাদ্বয়ই তেলাওয়াত করে বললেনঃ এই সূরাদ্বয় নিদ্রা যাওয়ার সময় এবং নিদ্রা শেষে বিছানা থেকে উঠার সময়ও পাঠ করো। অন্য হাদীসে তিনি প্রত্যেক নামাযের পর সূরাদ্বয় পাঠ করার আদেশ করেছেন। - (আবু দাউদ, নাসায়ী)[১০]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হাবীব বর্ণনা করেন, এক রাত্রিতে বৃষ্টি ও ভীষণ অন্ধকার ছিল। আমরা রসূলুল্লাহ -কে খুঁজতে বের হলাম। যাখন তাকে পেলাম, তখন প্রথমেই তিনি বললেনঃ বল। আমি আরয করলাম, কি বলব? তিনি বললেনঃ সূরা এখলাস ও কূল আউযু সূরাদ্বয়। সকাল-সন্ধ্যায় এগুলো তিন বার পাঠ করলে তুমি প্রত্যেক কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। - (মাযহারী)