কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কলকাতায় অবস্থিত একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ১৮৩৫ সালের ২৮জানুয়ারি মেডিকেল কলেজ, বেঙ্গল ননামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ব্রিটিশ ভারতে ইউরোপীয়দের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৪ সালেই ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস (আই.এম.এস) প্রতিষ্ঠা করে। বোম্বাই, কলকাতা ও মাদ্রাজের সামরিক ও বেসামরিক হাসপাতালগুলি আই.এম.এস অফিসারদের দ্বারাই পরিচালিত হতো। এরা কোম্পানির জাহাজে ও সেনাবাহিনীতেও কাজ করত। উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য ঔষধ প্রস্ত্ততকারক, কম্পাউন্ডার ও ড্রেসার অর্থাৎ ক্ষত পরিষ্কারক সরবরাহের প্রয়োজন থেকেই ভারতবর্ষে চিকিৎসা শিক্ষায় ইংরেজ সরকার জড়িয়ে পড়ে। এসব ঔষধ প্রস্ত্ততাকারক, কম্পাউন্ডার ও ড্রেসারদের কাজ ছিল ইউরোপীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ইউরোপীয় ডাক্তার ও সার্জনদের সহায়তা প্রদান করা। তাছাড়া ইউরোপীয় ডাক্তার নিযুক্তিকে সীমিত করার মাধ্যমে কোম্পানির ব্যয়ের বোঝা লাঘব করাও ছিল এ সাহায্যকারীদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্য।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
১৮২২ সালের ৯ মে ইংরেজ সরকার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশিয় ডাক্তারদের পদ পূরণের জন্য কুড়িজন পর্যন্ত তরুণ ভারতীয়কে প্রশিক্ষিত করে তোলা। উক্ত পরিকল্পনার সূত্র ধরে ১৮২২ সালের ২১ জুন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দি নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন’ (এন.এম.আই)। এ প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষায় চিকিৎসা শিক্ষা দেওয়া হতো। এতদুদ্দেশ্যে ছাত্রদের জন্য ইউরোপীয় ভাষা থেকে অ্যানাটমি, মেডিসিন ও সার্জারি বিষয়ের পুস্তক অনুবাদ করা হয়। ১৮২৬ সাল থেকে কলকাতা মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজে যথাক্রমে ইউনানি ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ক্লাস শুরু হয়।
১৮২৭ সালে এন.এম.আই-এর প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট প্রাচ্যবিদ জন টাইটলার সংসষ্ণৃত কলেজ এ অঙ্কশাস্ত্র ও অ্যানাটমি বিষয়ে লেকচার দেওয়া শুরু করেন। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এ পর্যায়ে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যে চিকিৎসা শিক্ষা প্রচলন করা হয় তাতে পাশ্চাত্য ও দেশিয় উভয়বিধ চিকিৎসাপদ্ধতি সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলে। পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তকের অনুবাদ উৎসাহিত করা হয়। যদিও শব-ব্যবচ্ছেদ প্রচলিত ছিল না, কিন্তু ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল। প্রশিক্ষণার্থী ছাত্রদেরকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডিসপেনসারিতে হাতে কলমে শিখবার জন্য যেতে হতো। দেশিয় ডাক্তারদের মধ্যে যারা সাফল্য অর্জন করতেন, তাদেরকে সরকারি চাকুরিতে নেওয়া হতো। চিকিৎসা শিক্ষার অবস্থার উপর রিপোর্ট প্রদানের জন্য এবং দেশিয় পদ্ধতির শিক্ষা রদ করা উচিত কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য লর্ড উইলিয়ম এর সরকার ১৮৩৩ সালের শেষের দিকে একটি কমিটি নিয়োগ করেন। ডাঃ জন গ্রান্ট এ কমিটির সভাপতি এবং জে.সি.সি সাদারল্যান্ড, সি.ই ট্রেভেলিয়ন, টমাস স্পেন্স্, রামকমল সেন ও এম.জে ব্রামলি এর সদস্য ছিলেন। কমিটি এন.এম.আই-প্রদত্ত চিকিৎসা শিক্ষার ত্রুটিপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং ব্যবহারিক শব ব্যবচ্ছেদবিদ্যা না থাকার জন্য তার সমালোচনা করে। কমিটি ১৮৩৪ সালের ২০ অক্টোবর তার রিপোর্ট দাখিল করে। এতে ‘ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য’ রাজ্যে একটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়, যেখানে ইউরোপে প্রচলিত চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষাদান করা হবে। শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দুস্থানি ভাষায় পড়া ও লেখার জ্ঞান থাকতে হবে এবং অঙ্কশাস্ত্রে দখল থাকতে হবে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। বেন্টিঙ্ক কমিটির সুপারিশের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফলে কলকাতার দুটি নেতৃস্থানীয় বিদ্যাপীঠে দেশিয় ডাক্তারদের জন্য প্রবর্তিত চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটে। এন.এম.আই অবলুপ্ত করা হয় এবং সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসায় চালু চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক ক্লাস ১৮৩৫ সালের ২৮ জানুয়ারিতে জারি করা এক সরকারি আদেশে বন্ধ হয়ে যায়। প্রস্তাবিত নতুন কলেজটির নাম হয় ‘কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ’ (সি.এম.সি)। ২০ ফেব্রুয়ারির এক আদেশবলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গে শুরু হয় ভারতবর্ষের চিকিৎসা শিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রে রীতিসিদ্ধ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সি.এম.সি প্রাচ্যে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সের দেশিয় তরুণদের ইউরোপে প্রচলিত চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত করে তোলাই ছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ঘোষিত লক্ষ্য। এরই সঙ্গে দেশিয় চিকিৎসা শিক্ষার প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অবসান ঘটে। এর ফলে দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থার অনুসারী ভারতীয় চিকিৎসকদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদীরাও দেশিয় পদ্ধতি বর্জনের সরকারি পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে। নব প্রবর্তিত এ শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া সর্বত্র এক ছিলনা। হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও তাঁতীরা এ ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানায়। ১৮৩৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র ভর্তির মধ্য দিয়ে কলেজের কর্মকান্ড শুরু হয়। প্রায় একশ ছাত্রের মধ্য থেকে হিন্দু কলেজ, হেয়ার স্কুল, বা জেনারেল অ্যাসেম্বলিস ইনস্টিটিউশন-এ লেখাপড়া করেছে এমন ২০ জনকে প্রাথমিক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির জন্য নির্বাচন করা হয়। আরও ঊনত্রিশ জন ছাত্র ইতঃপূর্বে নির্বাচিত হয়েছিল। স্থির ছিল এ ঊনপঞ্চাশ জনের সবাই মাসিক ৭ টাকা হারে সরকারি বৃত্তি পাবে এবং এ অর্থের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে; এদেরকে চার থেকে ছয় বছর কলেজে থাকতে হবে; কলেজের পাঠ সম্পন্ন করার পর এদেরকে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে; উত্তীর্ণ ছাত্রেরা শিক্ষা কমিটির প্রেসিডেন্ট-এর কাছ থেকে যোগ্যতার সার্টিফিকেট লাভ করবে, যাতে তারা সার্জারি ও ভেষজবিদ্যার চর্চা করতে পারে; তারা সরকারি চাকুরিতেও যোগদান করতে পারবে; সেক্ষেত্রে তাদেরকে ‘নেটিভ ডক্টর’ বা দেশি ডাক্তার বলা হবে; তাদের প্রারম্ভিক বেতন হবে মাসিক ৩০ টাকা; সাত বছর পর এ বেতন ৪০ টাকা এবং চৌদ্দ বছর পর ৫০ টাকা হবে। কলেজটিকে একজন সার্বক্ষণিক সুপারিনটেনডেন্ট-এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। তাকে সহায়তা করার জন্য ছিলেন একজন ইউরোপীয় অ্যাসিসট্যান্ট। ছাত্রদের শিক্ষার জন্য সরকারের তরফ থেকে একটি উপযুক্ত ভবন, একটি লাইব্রেরি এবং অ্যানাটমি শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করা ছিল। হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য ছাত্রদেরকে জেনারেল হাসপাতাল, নেটিভ হাসপাতাল, দি অনারেবল কোম্পানিস ডিসপেনসারি এবং দরিদ্রদের জন্য স্থাপিত ডিসপেনসারি সমূহ ও চক্ষু-চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হতো। ডাঃ এম.জে ব্রামলিকে সুপারিনটেনডেন্ট এবং ডাঃ এইচ.এইচ গুডইভ ও ডব্লিউ.বিও’শাফনেসী-কে অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন থেকে মধুসূদন গুপ্ত নামে কেবল একজন ষ্টাফকে নতুন কলেজে নিয়ে আসা হয়। মধুসূদন গুপ্ত পাশ্চাত্য চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আয়ুর্বেদ চর্চা করতেন। হিন্দু কলেজের পেছন দিকে একটি পুরনো ভবনে ক্লাস শুরু হয়। ১৮৩৫ সালের মে মাসে নতুন প্রাঙ্গনে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয়। অদ্যাবধি কলেজটি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম বছর অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লেকচার দেওয়া হয়। ও’শাফনেসী ১৮৩৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম দফায় এবং এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় রসায়ন বিষয়ে লেকচার দান করেন। ১৮৩৭ ও ১৮৩৮ সালে কলেজের শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। সার্জারি ও ক্লিনিক্যাল সার্জারির অধ্যাপক হিসেবে সি.সি এগারটন, বোটানির অধ্যাপক হিসেবে নাথানিয়েল ওয়ালিচ এবং আর ও’শাফনেসী অ্যানাটমির ডেমনস্ট্রেটর হিসেবে যোগ দেন। ব্রিটিশ ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্তারের ইতিহাসে ১৮৩৬ সাল একটি যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। এ বছরই প্রথম ভারতীয় ছাত্রেরা শব ব্যবচ্ছেদ করে। অনেকেই মনে করেন মধুসূদন গুপ্তই প্রথম ভারতীয় যিনি মানব দেহের শব ব্যবচ্ছেদ করেন। এ ঘটনার কতিপয় বিবরণ থেকে জানা যায়, ছাত্র হিসেবে উমাচরণ শেট, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র সর্ব প্রথম শব ব্যবচ্ছেদে অংশ গ্রহণ করে। ১৮৩৮ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় এরা উত্তীর্ণ হয় এবং সার্জারি ও মেডিসিনে যোগ্য ঘোষিত হয়। এদেরকেই পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রে যোগ্যতা অর্জনকারী প্রথম ভারতীয় হিসেবে দেখা হয় এবং এরাই প্রথম সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন হিসেবে সরকারি নিয়োগ লাভ করে XvKv, মুর্শিদাবাদ, পাটনা ও চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলিতে যোগদান করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামকমল সেন প্রমুখের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরা কৃতী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করে সি.এম.সি-তে চিকিৎসা শিক্ষাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রফেসর গুডইভ ও আংশিকভাবে ব্রিটিশ সরকার কলেজের চারজন ছাত্রকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে বিলেতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এদের মধ্যে তিন জন দ্বারকানাথ বসু, ভোলা নাথ বসু ও গোপাল চন্দ্র শীল ১৮৪৬ সালে মেম্বার অব দি রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস্ (এম.আর.সি.এস) ডিগ্রি লাভের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ভারতে প্রত্যাবর্তন করে অচুক্তিবদ্ধ মেডিক্যাল সার্ভিস-এ যোগদান করেন। চতুর্থজন সূর্য কুমার চক্রবর্তী বিলেতে থেকে যান এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন থেকে এম.ডি ডিগ্রি অর্জন করে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস-এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং চুক্তিবদ্ধ মেডিক্যাল সার্ভিস-এ যোগ দেন। শ্রী চক্রবর্তী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেন এবং ১৮৬৪ সাল থেকে ১৮৭৪ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ম্যাটেরিয়া মেডিকা অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৮৪২ সালে কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর স্থলে একটি কাউন্সিল অব এডুকেশন গঠন করা হয়। এ কাউন্সিল পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করে। ১৮৪৪ সালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস্-এর পরামর্শক্রমে নতুন পাঠ্যসূচি চালু করা হয়। ১৮৪৬ সালে এ পাঠ্যসূচি রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস্, লন্ডন ইউনিভার্সিটি ও সোসাইটি অব এ্যাপথেকারীজ-এর স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদানের জন্য এতে চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগ খোলা হয়। এ বিভাগ দ্বারা মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যসূচিতে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদান করত। এ তিনটি ডিগ্রি হচ্ছে: লাইসেনশিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (এল.এম.এস), ব্যাচেলর ইন মেডিসিন (এম.বি) ও ডক্টর অব মেডিসিন (এম.ডি)। কলেজে অন্যান্য যে সকল পরিবর্তন আনা হয় সেগুলির লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে মহামারী রোধের জন্য আরও অধিকসংখ্যক চিকিৎসক সরবরাহ করা। ১৮৩৯ সালের আগস্ট মসে জারি করা এক আদেশে উর্দু ও হিন্দুস্থানি ভাষার মাধ্যমে চিকিৎসা শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এতে অ্যানাটমি, ম্যাটেরিয়া মেডিকা, ভেষজবিদ্যা ও সার্জারি বিষয় পাঠদান করা হতো। শব ব্যবচ্ছেদ ও পাঠদান পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য নীতিমালা অনুসরণ করা হতো। প্রাথমিকভাবে ৫০ জন ছাত্রকে নির্বাচন করা হয়। এদের প্রত্যেককে মাসিক ৫ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হতো। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দায়িত্ব পালন করে এদেরকে ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ নিতে হতো। ১৮৪০ সালে জনসাধারণের চাঁদায় কলেজ প্রাঙ্গনে ১০০ শয্যার একটি মহিলা হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। এর পর ১৮৫৩ সালে ৩৫০ জন রোগীর সংকুলান করে একটি বড় হাসপাতাল স্থাপিত হয়। অন্যান্য হাসপাতালের মধ্যে ছিল: ইডেন হসপিটাল (১৮৮১-৮২), এযরা হসপিটাল (১৮৮৭), শ্যামাচরণ লাহা আই হসপিটাল এবং ১৯১১ সালের মার্চে স্থাপিত প্রিন্স অব ওয়েলস সার্জিক্যাল ব্লক। ১৮৫৭ সালের পূর্বে প্রসূতি ক্লাসে ভর্তিচ্ছু ছাত্রের সংখ্যা ২৮ থেকে ৬৯-এর মধ্যে ওঠানামা করত। ১৮৫৭ সালের পরে এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশিয় চিকিৎসা ডিপ্লোমার জন্য ছাত্রদেরকে অধ্যয়ন পর্বের শেষে অ্যানাটমি, ম্যাটেরিয়া মেডিকা, সার্জারি ও ভেষজবিদ্যায় পরীক্ষা দিতে হতো। দেশিয় চিকিৎসকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে একটি বাংলা ক্লাস প্রবর্তন করেন। এ ক্লাসে ভর্তির জন্য বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন আবশ্যিক ছিল। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কোর্সসমূহ ছিল হিন্দুস্থানি ক্লাসের মতোই। এ ক্লাসে ভর্তি হওয়া ২১ জন ছাত্রের পরীক্ষা নেওয়া হয় ১৮৫৩ সালে। যারা পাস করে তারা হসপিটাল অ্যাপ্রেনটিসেস অথবা ভার্নাক্যুলার লাইসেনশিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (ভি.এল.এম.এম)-এর মতো স্বাস্থ্য সেবায় অধস্তন ব্যক্তি হিসেবে চাকুরি পায়। এদের কেউ কেউ আবার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট-এর অধীনে দাতব্য চিকিৎসালয় ও জেল হাসপাতালে নিয়োগ লাভ করে। ১৮৫৬-৫৭ সালে বাংলা ক্লাসে ৮৮ জন ছাত্র ছিল। ১৮৭২ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৩৫ জনে। ছাত্ররা মুখ্যত ছিল ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য শ্রেণির। ১৮৬৪ সালে বাংলা ক্লাশটিকে দুটি শাখায় ভাগ করা হয়: এর একটি ‘দি নেটিভ অ্যাপথেকারী’ শাখা; এতে ছাত্রদের সরকারি চাকুরির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। অন্যটি ‘ভার্নাক্যুলার লাইসেনশিয়েট’ শাখা; এখানে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের ভারতীয়দের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ছাত্রদের ভেষজবিদ্যা ও সার্জারিতে শিক্ষা দেওয়া হতো। এ দুটি শাখাকেই ১৮৭৩ সালে ‘শিয়ালদা মেডিক্যাল স্কুল’ বা ‘ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল’ নামে একটি নতুন স্কুলে স্থানান্তরিত করা হয়। ছাত্রদের অধিকাংশ ছিল ইউরোপীয়,& ইউরেশীয় ও হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির। ১৮৮০-১৮৯০-এর দশকে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেলেও তা ছিল অত্যন্ত কম। ১৮৮৩ সালের ২৯ জুন গৃহীত এক সিদ্ধান্ত মোতাবেক এফ.এ. পাসের পর মহিলাদেরকে সি.এম.সি-তে ভর্তি হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। বাঙালি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে আগত কাদম্বিনী গাঙ্গুলী সি.এম.সি-তে ভর্তি হওয়া প্রথম ভারতীয় মহিলা। ১৮৮৪ সালে সমস্ত মহিলা ছাত্রের জন্য মাসিক ২০ টাকা সরকারি বৃত্তি ঘোষণা করা হয়। বিধুমুখী বসু ও ভার্জিনিয়া ম্যারী মিত্র এ বৃত্তি লাভ করেন এবং প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে ১৮৮৮-৮৯ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।